কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সুযোগের পাশাপাশি ভয়াবহ ঝুঁকি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সুযোগের পাশাপাশি ভয়াবহ ঝুঁকি
সর্বশেষ আপডেট: 30-05-2025

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আজ আমাদের জীবন বদলে দিচ্ছে—স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন ও সুরক্ষা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু AI-এর কিছু দিক রয়েছে যা এর সুফলগুলির মতোই বিপজ্জনক ও ভয়াবহ হতে পারে। আধুনিক যুগের এই প্রযুক্তি যদি মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে সমগ্র মানব সমাজ বিপন্ন হতে পারে।

জিন সম্পাদনা: মানুষকে যন্ত্রের মতো তৈরির সূচনা?

CRISPR-Cas9 এবং অন্যান্য জিন সম্পাদনা প্রযুক্তি অনেক অসারোগ্য রোগের চিকিৎসা সহজ করেছে, তবে একই প্রযুক্তি মানব DNA সম্পাদন করে "ডিজাইনার শিশু" তৈরির পথও খুলে দিচ্ছে। যদি এই প্রযুক্তি নীতিবোধ ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ব্যবহার করা হয়, তাহলে এমন এক জগতের সৃষ্টি হতে পারে যেখানে ধনী ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদের বিশেষ প্রতিভা, রঙ, উচ্চতা ও বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিতে তৈরি করতে পারবে। এতে সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে এবং নতুন জাতিগত উত্তেজনা সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি জৈবিক অস্ত্রের উন্নয়নও সম্ভব হবে, যার মাধ্যমে কোনও ভাইরাস বা রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে।

ডিপফেক ও ক্লোনিং: সত্য ও মিথ্যায় পার্থক্য মুছে ফেলার প্রযুক্তি

AI-ভিত্তিক Deepfake প্রযুক্তি এতটাই উন্নত হয়েছে যে যেকোনো ব্যক্তির মুখ, কণ্ঠ ও ভঙ্গিমা हूबहू অনুকরণ করা যায়। এর ফলে মিথ্যা ভিডিও তৈরি করা এখন মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার। কোনো রাজনীতিকের নকল বক্তব্য ভাইরাল করে নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলা যায়, আবার কোনো ব্যক্তির ছবি নষ্ট করার জন্য তাকে অপরাধী হিসেবে দেখানো যায়। এই ভিডিওগুলি শুধুমাত্র গুজব ছড়াতে সাহায্য করে না, বরং সমাজে উত্তেজনা, ঘৃণা ও হিংসাও বৃদ্ধি করতে পারে।

স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র: যখন মেশিন মানুষের আদেশ ছাড়াই আক্রমণ শুরু করবে

AI-এর সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যবহারগুলির মধ্যে একটি হল Autonomous Weapons Systems, অর্থাৎ এমন অস্ত্র যা মানুষের আদেশ ছাড়াই নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে শত্রুকে আক্রমণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার Uran-9 এবং আমেরিকার Loyal Wingman এর মতো যুদ্ধবিমান সম্পূর্ণরূপে AI প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে।

যদি কোনোদিন এই অস্ত্রগুলি পুরোপুরি স্বাধীনতা পায় এবং নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে, তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে ভুলবশত নিরপরাধদের প্রাণহানি হতে পারে। হ্যাকিং, প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা তথ্যে ত্রুটির ফলে এই অস্ত্রগুলি মানব সভ্যতার জন্য বিধ্বংসী হতে পারে।

জিয়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং: আবহাওয়ার সাথে ছিনিমিনি, কিন্তু ফলাফল অজানা

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বিজ্ঞানীরা জিওইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আশ্রয় নিচ্ছেন, বিশেষ করে Solar Radiation Management (SRM) প্রযুক্তির মাধ্যমে, যেখানে বায়ুমণ্ডলে সালফার কণা ছাড়া হয় যাতে সূর্যের তাপ কম করা যায়। কিন্তু এই পরীক্ষা পরিবেশের উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। বৃষ্টিপাত চক্রে বাধা, ফসল উৎপাদনে প্রভাব এবং বিশ্বব্যাপী ভারসাম্যহীনতা-সহ ঝুঁকি এই প্রযুক্তিকে অত্যন্ত সংবেদনশীল করে তোলে। কোনও দেশ যদি নিজের স্বার্থে আবহাওয়া পরিবর্তনের চেষ্টা করে, তাহলে এর প্রভাব অন্য দেশের উপরও পড়বে, যার ফলে আন্তর্জাতিক সংঘাতের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

মিথ্যা সংবাদের সাম্রাজ্য: গণতন্ত্রকে গ্রাস করার ষড়যন্ত্র

AI আজ মিথ্যা সংবাদ ও প্রচারণা ছড়ানোর সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। GPT-এর মতো টেক্সট জেনারেশন মডেল ও বটের মাধ্যমে হাজার হাজার মিথ্যা সংবাদ নিবন্ধ, টুইট ও পোস্ট মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়। এর উদ্দেশ্য হল রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রভাবিত করা, সমাজে বিভ্রান্তি ও ঘৃণা ছড়ানো এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা। এতে গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয় এবং জনগণ প্রকৃত বিষয় থেকে বিভ্রান্ত হয়।

মস্তিষ্ক-কম্পিউটার ইন্টারফেস: মানুষের চিন্তাভাবনার উপরও দখল?

Neuralink-এর মতো কোম্পানিগুলি মানুষের মস্তিষ্ককে কম্পিউটারের সাথে সংযুক্ত করার দিকে দ্রুত কাজ করছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব হতে পারে, তবে যদি এটি মানুষের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবহার করা হয়, তাহলে এটি আমাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নষ্ট করতে পারে। চিন্তা, অনুভূতি ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতাই মানুষকে মানুষ করে তোলে—যদি এই ক্ষমতাগুলি অন্য কারও 'কোডিং'-এর উপর নির্ভর করে, তাহলে এটিই হবে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।

AI-চালিত গুপ্তচরবৃত্তি ব্যবস্থা: প্রতিটি কাজের উপর নজরদারি

AI-ভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থা যেমন Facial Recognition ও Predictive Policing এখন বিশ্বের অনেক অংশে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তি নিরাপত্তার জন্য ভালো, কিন্তু যদি এর অপব্যবহার হয়, তাহলে এটি একটি নজরদারি রাষ্ট্র (Surveillance State) সৃষ্টি করতে পারে। মানুষের গোপনীয়তা বিপন্ন হতে পারে, এবং তারা সর্বদা ভাবতে বাধ্য হতে পারে যে কেউ তাদের দেখছে কিনা। চীনের মতো দেশে এর আগে থেকেই ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে।

Leave a comment