শেষ কয়েকদিনে যদি আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন সুন্দর এনিমেশন-সদৃশ ছবি দেখে থাকেন, যেখানে মানুষগুলো স্টুডিও ঘিব্লি ছবির চরিত্রের মতো দেখাচ্ছে, তাহলে আপনি একা নন। এটি ওপেনএআই-এর নতুন ঘিব্লি ট্রেন্ড, যা ইন্টারনেট জগতে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকারি অ্যাকাউন্ট এবং বলিউড তারকাসহ সকলেই এই ট্রেন্ডে অংশ নিয়েছে। কিন্তু এই রঙিন ও কলাকৌশলী ট্রেন্ডের পেছনে কিছু ঝুঁকি লুকিয়ে আছে, যা আপনার ব্যক্তিগত তথ্যের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
ঘিব্লি ট্রেন্ড কী?
ঘিব্লি ট্রেন্ড হলো একটি AI-ভিত্তিক ইমেজ জেনারেশন ট্রেন্ড, যেখানে ব্যবহারকারীরা তাদের প্রকৃত ছবিগুলোকে স্টুডিও ঘিব্লির ছবির স্টাইলে রূপান্তর করে। স্টুডিও ঘিব্লি হলো জাপানের একটি বিখ্যাত এনিমেশন ফিল্ম স্টুডিও, যা মাই নেইবার টোটোরো, স্পিরিটেড অ্যাওয়ে, হাওল'স মুভিং ক্যাসেল-এর মতো ছবি দিয়ে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ওপেনএআই-এর GPT-4o মডেলের ইমেজ জেনারেশন ফিচার চালু হওয়ার পর এই AI ট্রেন্ড ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
কীভাবে ট্রেন্ডটি ভাইরাল হয়েছে?
এই ট্রেন্ডকে প্রথম জনপ্রিয় করেছিলেন আমেরিকার একজন সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার গ্রান্ট স্লাটন। তিনি তার পরিবারের একটি ছবি AI-এর সাহায্যে ঘিব্লি স্টাইলে পরিবর্তন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন। এই পোস্টটি এত দ্রুত ভাইরাল হয় যে ৫ কোটিরও বেশি বার দেখা হয়। এরপর বিশ্বজুড়ে ব্যবহারকারী, প্রভাবক, ব্র্যান্ড এবং এমনকি ভারত সরকারের MyGovIndia অ্যাকাউন্টও এতে অংশ নেয়।
সচিন তেন্ডুলকর এবং অমিতাভ বচ্চনের মতো বড় বড় তারকাসহ অনেকেই এই ট্রেন্ডে যোগ দেন এবং তাদের AI-জেনারেটেড ঘিব্লি-স্টাইল ছবি পোস্ট করেন, যার ফলে এটি আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
প্রযুক্তির পেছনে ওপেনএআই এবং GPT-4o
মার্চ ২০২৫ সালে ওপেনএআই তাদের GPT-4o মডেল চালু করে, যা শুধুমাত্র টেক্সট নয়, ইমেজ এবং অডিও ইনপুটও প্রসেস করতে পারে। এরপর কোম্পানিটি ChatGPT-তে ইমেজ জেনারেশন টুল যোগ করে, যেখানে ব্যবহারকারীরা তাদের ছবি আপলোড করে যেকোনো স্টাইলে রূপান্তর করতে পারে – ঘিব্লি স্টাইল সেগুলোর মধ্যে একটি।
এই ফিচারটি প্রথমে শুধুমাত্র পেইড ব্যবহারকারীদের জন্য উপলব্ধ ছিল, কিন্তু পরে এটি ফ্রি ব্যবহারকারীদের জন্যও রোল আউট করা হয়। তারপর কী হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ফিচারের দিকে আকৃষ্ট হয়।
ট্রেন্ডের পেছনে লুকানো ঝুঁকি: প্রাইভেসি এবং ডেটা
ঘিব্লি ট্রেন্ড যতটা আকর্ষণীয় মনে হয়, ততটাই বিপজ্জনকও হতে পারে – বিশেষ করে ডেটা সুরক্ষা এবং প্রাইভেসির দিক থেকে। ওপেনএআই-এর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী:
- ব্যবহারকারীদের দ্বারা আপলোড করা ছবি, টেক্সট বা অন্যান্য ফাইল কোম্পানির AI মডেলকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতে পারে।
- যদি ব্যবহারকারী নিজে সেটিংসে গিয়ে opt-out না করে, তাহলে তার ছবি এবং ইনপুট ডেটা ওপেনএআই-এর সার্ভারে সংরক্ষণ করা হতে পারে।
- ডিলিট করার পরেও, ডেটা সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলতে ৩০ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
এর অর্থ হলো, আপনি যদি মজা করে আপনার ছবি AI-কে দিয়ে থাকেন, তাহলে তা ওপেনএআই-এর সার্ভারে এক মাস পর্যন্ত থাকতে পারে – এবং কোম্পানি তাদের AI সিস্টেমকে উন্নত করার জন্য সেই ডেটার ব্যবহার করতে পারে।
সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য সতর্কতা
বেশিরভাগ মানুষ শর্তাবলী (terms & conditions) পড়ে না। তারা শুধু ট্রেন্ডে যোগ দিতে চায়। কিন্তু এই অসাবধানতা বড় বিপদের কারণ হতে পারে। আপনার ছবি, আপনার মুখ এবং তার সাথে জড়িত ভিজ্যুয়াল ডেটা ভবিষ্যতে ফেস রিকগনিশন, বিজ্ঞাপন, বা এমনকি ডিপফেকের মতো বিপজ্জনক টুলসের জন্যও ব্যবহার করা হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিচ্ছেন যে ঘিব্লি-এর মতো AI ট্রেন্ড ভবিষ্যতে ডিপফেক প্রযুক্তির নতুন মাত্রা খুলে দিতে পারে, যেখানে আপনার AI জেনারেটেড ছবির অপব্যবহার করা হতে পারে।
এই ট্রেন্ড থেকে কীভাবে দূরে থাকবেন বা নিরাপদ থাকবেন?
- ছবি আপলোড করার আগে ভাবুন – এই ছবিটি শেয়ার করার মতো কি?
- Terms & Conditions পড়ুন – বুঝুন আপনার তথ্য কীভাবে ব্যবহার করা হতে পারে।
- Privacy Settings চেক করুন – OpenAI-তে opt-out-এর অপশন নির্বাচন করুন।
- AI জেনারেটেড ছবি সর্বত্র শেয়ার করবেন না – যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ইত্যাদিতে।
- Face-based AI অ্যাপস থেকে দূরে থাকুন – যতক্ষণ না অত্যন্ত জরুরি না হয়।
ওপেনএআই-এর উত্তর কী?
ওপেনএআই-এর দাবি, তাদের সেবাগুলো স্বচ্ছতার সাথে কাজ করে এবং ব্যবহারকারীদের 'ডেটা কন্ট্রোল'-এর বিকল্প দেওয়া হয়। যদি আপনি ChatGPT-এর 'Settings'-এ গিয়ে 'Improve the model for everyone'-এর চেকবক্সটি সরিয়ে ফেলেন, তাহলে আপনার ডেটা প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত হবে না।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, খুব কম ব্যবহারকারীই এই অপশনের কথা জানেন বা এটি পরিবর্তন করেন। তাই বিশেষজ্ঞদের মনে হয়, ওপেনএআই-কে ব্যবহারকারীর ডেটার ব্যবহার সম্পর্কে আরও স্পষ্টভাবে তথ্য দিতে হবে।