ভারতে উৎপাদিত স্মার্টফোন ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির চাহিদা এখন বিশ্ববাজারে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে চীনা কোম্পানি যেমন ওপ্পো, রিয়েলমি এবং হাইসেন্স এখন ভারতে উৎপাদন করে পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকা বাজারে রপ্তানি করছে।
নয়াদিল্লি: ভারত এখন শুধুমাত্র একটি বৃহৎ বাজার নয়, বরং একটি বিশ্বব্যাপী উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠছে। বিশেষ করে চীনের বৃহৎ মোবাইল এবং ইলেকট্রনিক কোম্পানিগুলি ভারতে ব্যাপক উৎপাদন শুরু করেছে এবং এখন তারা এখানে তৈরি পণ্যগুলি বিদেশী বাজারে রপ্তানি করছে। এর ফলে ভারত কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুবিধা পাচ্ছে।
২০২০ সালে ভারত-চীন সীমান্তে উত্তেজনার পর ভারত সরকার চীনা কোম্পানিগুলির উপর কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং তাদের ভারতে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের জন্য উৎসাহিত করে। এর ফল এখন দেখা যাচ্ছে, যখন ওপ্পো, রিয়েলমি, হাইসেন্স, লেনোভো, মোটোরোলা প্রভৃতি কোম্পানিগুলি ভারতকে কেবলমাত্র উৎপাদন কেন্দ্রই নয়, বরং এখান থেকেই পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকা போன்ற বৃহৎ বাজারে তাদের পণ্য রপ্তানি করছে।
প্রথমবার ওপ্পো এবং রিয়েলমি ভারত থেকে কোটি কোটি টাকা আয়
২০২৪ সালের অর্থবর্ষে ওপ্পো মোবাইল ইন্ডিয়া প্রথমবার ভারত থেকে রপ্তানি করে ২৭২ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। একইভাবে রিয়েলমি ১১৪ কোটি টাকার রপ্তানি করেছে। এই তথ্যগুলি কম্পানি রেজিস্ট্রারকে প্রদত্ত তথ্য থেকে পাওয়া গেছে।
পূর্বে এই কোম্পানিগুলি কেবলমাত্র ভারতে তাদের ফোন বিক্রি করত, কিন্তু এখন ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ ট্যাগ নিয়ে বিদেশেও তাদের পরিচয় তৈরি হচ্ছে। এই কোম্পানিগুলির ফোন পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকার গ্রাহকদের পছন্দ হচ্ছে।
হাইসেন্সও ভারতে টিভি তৈরি করবে, শুরু হবে রপ্তানি
চীনের আরেকটি বৃহৎ কোম্পানি হাইসেন্স, যা টেলিভিশন এবং গৃহস্থালী যন্ত্রপাতির বিশ্বের অগ্রণী কোম্পানিগুলির মধ্যে একটি, ভারত থেকে পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকায় টিভি এবং গৃহস্থালী যন্ত্রপাতি রপ্তানি করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। হাইসেন্সের উৎপাদন সহযোগী এপ্যাক ডুরেবল শ্রীসিটি (অন্ধ্রপ্রদেশ)তে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি নতুন প্ল্যান্ট স্থাপন করছে। এই প্ল্যান্ট সম্পূর্ণরূপে চীনের উৎপাদন মান অনুযায়ী হবে।
মোটোরোলা, লেনোভো এবং ডিক্সন টেকনোলজিও পিছনে নেই
লেনোভো গ্রুপ এখন ভারত থেকে সার্ভার এবং ল্যাপটপ রপ্তানির পরিকল্পনা করছে। তার মোবাইল ইউনিট মোটোরোলা ইতোমধ্যেই আমেরিকাকে তার মোবাইল ডিভাইস রপ্তানি করছে। মোটোরোলার স্মার্টফোন ভারতের কোম্পানি ডিক্সন টেকনোলজিস তৈরি করে।
ডিক্সন এখন তার উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াচ্ছে যাতে সে বর্ধিত আন্তর্জাতিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। একই ডিক্সন টেকনোলজিস ট্রানজিশন হোল্ডিংসের জন্যও স্মার্টফোন তৈরি করে, যা টেকনো, ইন্টেল এবং ইনফিনিক্স প্রভৃতি ব্র্যান্ডের মালিক।
ট্রানজিশন হোল্ডিংস এখন আফ্রিকায় রপ্তানি শুরু করেছে, যেখানে তাদের সাশ্রয়ী মূল্যের স্মার্টফোন খুব জনপ্রিয়।
ভারতীয় অংশীদারিত্ব এবং সরকারের কঠোরতার প্রভাব
সরকার স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, যদি চীনা কোম্পানিগুলি ভারতে ব্যবসা করতে চায়, তাহলে তাদের এখানেই উৎপাদন করতে হবে। পাশাপাশি তারা চীনা কোম্পানিগুলিকে অনুরোধ করেছে যে তারা ভারতীয় অংশীদারদের সাথে মিলে উৎপাদন ইউনিট তৈরি করুক, ভারতীয়দের উচ্চপদে নিয়োগ করুক এবং ভারতকে কেবলমাত্র বাজার নয়, উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তুলুক।
এই নীতির প্রভাব এখন দেখা যাচ্ছে। চীনা কোম্পানিগুলি এখন ভারতীয় কোম্পানিগুলির সাথে মিলে উৎপাদন করছে। যেমন ডিক্সন টেকনোলজিস, এপ্যাক ডুরেবল এবং অন্যান্য অনেক উৎপাদন অংশীদারদের সাথে এই ব্র্যান্ডগুলি মিলে ভারতে উৎপাদন করছে।
পিএলআই পরিকল্পনা থেকেও উৎসাহ পাওয়া যাচ্ছে
ভারত সরকারের পিএলআই (প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেন্টিভ) পরিকল্পনাও এই কোম্পানিগুলির জন্য উপকারী প্রমাণিত হচ্ছে। যদিও অধিকাংশ চীনা কোম্পানি নিজেই এই পরিকল্পনার অংশ নয়, তবে তাদের চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনকারী যেমন ডিক্সন এই পরিকল্পনার সুবিধাভোগী। এর ফলে তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রপ্তানির নতুন সুযোগ পাচ্ছে।
আমেরিকার ট্যারিফ এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রভাব
আমেরিকা কর্তৃক চীনের উপর ট্যারিফ আরোপের হুমকি এবং বিশ্বব্যাপী চীনের বিরুদ্ধে সৃষ্ট পরিবেশও এই কোম্পানিগুলিকে ভারতের মতো বিকল্প খোঁজার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। ভারতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বর্ধিত উৎপাদন ক্ষমতা এবং সরকারের শিল্প-সমর্থক নীতিগুলি এটিকে চীনের একটি শক্তিশালী বিকল্প করে তুলেছে।
এখন অনেক চীনা কোম্পানি ভারত থেকে আমেরিকায় মোবাইল এবং ইলেকট্রনিক পণ্য পাঠানোর জন্য প্রস্তুত। তবে এতে আমেরিকার সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি এবং বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতিরও বড় ভূমিকা থাকবে।
চীন থেকে ভারতের দিকে ঝুঁকির ইঙ্গিত
এখন এ কথা বলা ভুল হবে না যে, অনেক চীনা কোম্পানি ভারতকে তাদের নতুন উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হল ভারতের বর্ধিত খরচ, সরকারী সহায়তা, শ্রমশক্তির উপলব্ধতা এবং উন্নত লজিস্টিক নেটওয়ার্ক। এছাড়াও চীনে মজুরি এবং রাজনৈতিক ঝুঁকির কারণে কোম্পানিগুলি তাদের উৎপাদন কেন্দ্রগুলি বৈচিত্র্যপূর্ণ করতে চায়।
ভবিষ্যতে ভারতের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ
ভারতে মোবাইল এবং ইলেকট্রনিক পণ্যের রপ্তানিতে যে উত্থান এসেছে, তা আগামী বছরগুলিতে আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। যদি সরকার পিএলআই পরিকল্পনা আরও সম্প্রসারিত করে এবং চীনা কোম্পানিগুলিকে ভারতে গবেষণা ও উন্নয়ন করার জন্য অনুপ্রাণিত করে, তাহলে ভারত কেবলমাত্র উৎপাদন কেন্দ্রই নয়, উদ্ভাবনের কেন্দ্রও হতে পারে।
এভাবে, মেড ইন ইন্ডিয়া চীনা ফোন এবং ইলেকট্রনিক পণ্যের বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা ভারতের জন্য একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক সুযোগ হিসেবে উঠে আসছে। এর ফলে কেবলমাত্র বৈদেশিক মুদ্রার বৃদ্ধিই নয়, লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে।