২০২৫ সালের মার্চ ত্রৈমাসিক ভারতের ব্যাংকিং খাতের জন্য তুলনামূলকভাবে দুর্বল প্রমাণিত হয়েছে। এই সময়কালে ব্যাংকগুলির মোট মুনাফা মাত্র এক অঙ্কের বৃদ্ধি দেখিয়েছে, যা গত চার বছর অর্থাৎ ১৭ টি ত্রৈমাসিকে প্রথমবারের মতো ঘটেছে।
ভারতীয় ব্যাংকিং খাত, যা গত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত মুনাফা এবং বৃদ্ধির নতুন নতুন রেকর্ড গড়ে তুলছে, ২০২৫ সালের মার্চ ত্রৈমাসিকে একটি নতুন সংকটের ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রের ব্যাংকগুলির মুনাফার হারে হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে ব্যাংকিং খাতের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এইবার ত্রৈমাসিক মুনাফা মাত্র এক অঙ্কের বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গত সাড়ে চার বছরে প্রথমবারের মতো ঘটেছে।
ব্যাংকগুলির নেট ইন্টারেস্ট ইনকাম (NII) এবং নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন (NIM) -এ হ্রাস তাদের মুনাফার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এছাড়াও, দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (SBI) -এর দুর্বল পারফরম্যান্স এই হ্রাসে প্রধান ভূমিকা পালন করছে।
মার্চ ত্রৈমাসিক: ব্যাংকগুলির জন্য হতাশাজনক
২০২৫ সালের মার্চ ত্রৈমাসিক ভারতীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ছিল। ২৯ টি ব্যাংকের একটি নমুনার বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে মোট নেট প্রফিটে মাত্র ৪.৯ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে, যা ৯৩,৮২৮.৩ কোটি টাকা। যদিও এটি নামমাত্র বৃদ্ধি, কিন্তু পূর্ববর্তী তথ্যের সাথে তুলনা করলে এটি অত্যন্ত হতাশাজনক।
এই হ্রাসের সবচেয়ে বড় কারণ স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া-র দুর্বল পারফরম্যান্স, যার মুনাফা ৯.৯ শতাংশ কমে ১৮,৬৪২.৬ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এই নমুনায় SBI-এর ২০ শতাংশ অংশগ্রহণ রয়েছে, যা স্পষ্ট করে যে এর দুর্বল পারফরম্যান্সের প্রভাব পুরো ব্যাংকিং খাতের উপর পড়েছে।
জনসাধারণ খাতের অবস্থা
জনসাধারণ খাতের ব্যাংকগুলি ১৩ শতাংশ মুনাফা বৃদ্ধি দেখিয়েছে, যা ৪৮,৪০৩.৪ কোটি টাকা। যদিও এই বৃদ্ধি গত ১১ টি ত্রৈমাসিকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২২ সালের জুন ত্রৈমাসিকে ৯.২ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল।
এর অর্থ হল যে জনসাধারণ খাতের ব্যাংকগুলি ধীরে ধীরে সেই গতি হারিয়ে ফেলছে, যার ফলে তারা গত কয়েক বছরে পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল।
বেসরকারি ব্যাংকগুলির অবস্থা আরও বেশি উদ্বেগজনক
যদি জনসাধারণ খাতের ব্যাংকগুলির অবস্থা উদ্বেগজনক হয়, তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলির অবস্থা আরও খারাপ দেখাচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলির মোট মুনাফা ২.৫ শতাংশ কমে ৪৫,৪২৪.৯ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। গত ১৩ টি ত্রৈমাসিকে প্রথমবারের মতো বেসরকারি ব্যাংকগুলির মুনাফায় বার্ষিক হ্রাস পেয়েছে।
এই হ্রাসের সরাসরি প্রভাব এই ব্যাংকগুলির মোট মুনাফায় অংশীদারিত্বের উপর পড়েছে, যা ৫২.১ শতাংশ থেকে কমে ৪৮.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি গত আটটি ত্রৈমাসিকের মধ্যে সর্বনিম্ন অংশগ্রহণ।
নেট ইন্টারেস্ট ইনকাম এবং মার্জিনের উপর চাপ
২০২৫ সালের মার্চ ত্রৈমাসিকে ব্যাংকগুলির নেট ইন্টারেস্ট ইনকাম মাত্র ৩.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২.১ লক্ষ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা গত ১৪ টি ত্রৈমাসিকের মধ্যে সর্বনিম্ন বৃদ্ধি।
জনসাধারণ খাতের ব্যাংকগুলির NII মাত্র ২.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে বেসরকারি ব্যাংকগুলি ৫.৩ শতাংশ বৃদ্ধি দেখিয়েছে। এই পার্থক্যটি ইঙ্গিত করে যে বেসরকারি ব্যাংকগুলি তাদের মূলধন এবং ঋণ পোর্টফোলিওকে আরও ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, কিন্তু সামগ্রিক পারফরম্যান্স তবুও দুর্বল ছিল।
NIM, অর্থাৎ নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন, -এর উপরও কয়েকটি ত্রৈমাসিক ধরে ক্রমাগত চাপ রয়েছে। ২৯ টির মধ্যে ১৯ টি ব্যাংক বার্ষিক ভিত্তিতে তাদের মার্জিনে হ্রাস দেখিয়েছে।
NIM: ব্যাংকগুলির আয়ের মেরুদণ্ড
নেট ইন্টারেস্ট মার্জিন কোনও ব্যাংকের আয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই হার ব্যাংকগুলি ঋণের উপর যে সুদের হার আয় করে এবং আমানতের উপর গ্রাহকদের যে সুদের হার দেয় তার পার্থক্য দেখায়।
যখন রেপো রেটে হ্রাস করা হয়, তখন ব্যাংকগুলি ঋণের উপর সুদের হার কমাতে বাধ্য হয়, কিন্তু আমানতের হার কমাতে সাধারণত সময় লাগে। यही কারণে ব্যাংকগুলির মার্জিন কমে এবং মুনাফার উপর প্রভাব পড়ে।
RBI-এর হস্তক্ষেপ: আশার আলো
রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া এই অবনতির অবস্থা উন্নত করার জন্য ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অতিরিক্ত তরলতা প্রবাহিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর সাথে সাথে সুদের হারেও হ্রাস করা হয়েছে, যার ফলে ঋণের খরচে সুবিধা পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপগুলির প্রভাব আগামী ত্রৈমাসিকগুলিতে দেখা যেতে পারে এবং ব্যাংকিং খাতের মুনাফার গতি পুনরায় পথে ফিরে আসতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব
ব্যাংকগুলির এই দুর্বল পারফরম্যান্সের একটি বড় কারণ বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মুদ্রাস্ফীতি এবং দেশীয় পর্যায়ে গ্রাহক চাহিদার মন্দা। যখন বিনিয়োগ এবং ঋণের চাহিদা কমে, তখন ব্যাংকিং কার্যকলাপের উপর সরাসরি প্রভাব পড়ে।
উদ্যোগগুলি ঋণ গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া, MSME খাতে ধীর প্রত্যাবর্তন এবং খুচরা ঋণে ঝুঁকির আশঙ্কা ব্যাংকগুলির ঋণ বৃদ্ধিকেও প্রভাবিত করেছে।
ডিজিটাল ব্যাংকিং এবং নতুন গ্রাহক মডেলের প্রভাব
ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং ডিজিটাল লেনদেনের বর্ধিত ভূমিকা ঐতিহ্যগত ব্যাংকগুলিকেও প্রভাবিত করেছে। নিয়োব্যাংকিং, ফিনটেক কোম্পানি এবং ডিজিটাল ওয়ালেটের বর্ধিত উপস্থিতি ব্যাংকগুলির জন্য প্রতিযোগিতাকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
এই ডিজিটাল পরিবর্তনের ফলে ঐতিহ্যগত ব্যাংকগুলিকে তাদের কৌশল পরিবর্তন করার প্রয়োজন রয়েছে যাতে তারা তাদের গ্রাহক সংখ্যা বজায় রাখতে পারে এবং নতুন গ্রাহকদের আকর্ষণ করতে পারে।
আগামীর পথ: কি কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত
ব্যাংকিং খাতকে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে:
- আমানত এবং ঋণের হারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা
- প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ এবং ডিজিটাল পরিষেবা উন্নত করা
- MSME এবং খুচরা গ্রাহকদের সহজ ঋণ প্রদান করা
- কর্মী এবং শাখা পর্যায়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করা
- গ্রাহক বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখা