ইরান-ইসরাইলের মধ্যে বর্ধমান সামরিক সংঘাত এবং তাতে সক্রিয়ভাবে আমেরিকার হস্তক্ষেপের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। এই অস্থিরতার প্রত্যক্ষ প্রভাব ভারতীয় শেয়ার বাজারেও দেখা যাচ্ছে।
২৩ জুন ২০২৫-তে ভারতীয় শেয়ার বাজারে তীব্র ধসের সাথে সপ্তাহের শুরু হয়েছে। পশ্চিম এশিয়ায় ইরান-ইসরাইলের চলমান সংঘাতে আমেরিকার হস্তক্ষেপে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও গভীর হয়েছে। আমেরিকার বোমা হামলার খবরের মধ্যে বিশ্ব বাজারের অনিশ্চয়তা ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের মানসিকতাকে কঠোরভাবে প্রভাবিত করেছে। সেনসেক্স এবং নিফটি উভয় সূচকই লাল পতাকা দেখিয়ে খোলে, এবং টাকারও মূল্য হ্রাস পায়।
তীব্র ধসের সাথে বাজারের শুরু
সোমবার সকালে যখন ভারতীয় বাজার খোলে, প্রথম ঘন্টাতেই বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সেনসেক্স প্রায় ৭০০ পয়েন্ট পর্যন্ত নেমে যায়। নিফটিও ধসের সাথে ২৪,৯২৯.৫০ পয়েন্টে খোলে, যা পূর্ববর্তী বন্ধের তুলনায় ১৮২.৯০ পয়েন্ট কম। এই ধস কেবলমাত্র আমেরিকা এবং ইরানের মধ্যে বর্ধমান উত্তেজনার ফল নয়, বরং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বর্ধমান আশঙ্কারও ইঙ্গিত দেয় যে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
যদিও শুক্রবার বাজার উজ্জ্বল প্রদর্শন করেছিল, যখন সেনসেক্স ১,০৪৬.৩০ পয়েন্ট বেড়ে ৮২,৪০৮.১৭ এ বন্ধ হয় এবং নিফটিও ৩১৯.১৫ পয়েন্ট লাফিয়ে ২৫,১১২.৪০ পয়েন্টে পৌঁছেছিল। কিন্তু সপ্তাহান্তের পর ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পূর্ণ চিত্র পালটে দিয়েছে।
আমেরিকার বোমা হামলায় বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ বেড়েছে
জিওজিৎ ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রধান বিনিয়োগ কৌশলবিদ ডাঃ ভি.কে. বিজয় কুমারের মতে, আমেরিকা কর্তৃক ইরানের তিনটি পারমাণবিক প্রতিষ্ঠানে বোমা হামলায় পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। যদিও ঘরোয়া অর্থনৈতিক ইঙ্গিত এখনও স্থির মনে হয়, তবে বাজারের সংবেদনশীলতা এই ধরনের ঘটনায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়।
ডাঃ কুমার মনে করেন, বর্তমানে যে ধস দেখা যাচ্ছে তা আংশিক এবং যদি ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়ে তাহলে এর প্রভাব আরও ব্যাপক হতে পারে। এই অঞ্চলে শান্তি ফিরে না আসা পর্যন্ত বাজারে অস্থিরতা অব্যাহত থাকতে পারে।
পতনশীল টাকা, সতর্ক বিদেশী বিনিয়োগকারী
কেবলমাত্র শেয়ার বাজার নয়, ভারতীয় মুদ্রা টাকার উপরও এই উত্তেজনার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা গেছে। সোমবার টাকা ১৭ পয়সা কমে ৮৬.৭৬-এ খোলে, যেখানে শুক্রবার এটি ৮৬.৫৯-এ বন্ধ হয়েছিল। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিক্রয় এবং ডলারের শক্তি টাকাকে দুর্বল করেছে।
কারেন্সি বিশেষজ্ঞদের মতে, যখনই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুদ্ধ বা উত্তেজনার অবস্থা তৈরি হয়, তখন বিনিয়োগকারীরা ডলারের মতো নিরাপদ সম্পদের দিকে ছুটে যান, যার ফলে উদীয়মান বাজারের মুদ্রা চাপে পড়ে। এ কারণেই টাকা এখন দুর্বল হচ্ছে।
আইটি এবং ধাতু খাতে সবচেয়ে বেশি চাপ
শেয়ার বাজারে সোমবারের ধসে আইটি, ধাতু এবং অটো খাত প্রধানত প্রভাবিত হয়েছে। বিশেষ করে ইনফোসিসের শেয়ারে দুই শতাংশের ধস দেখা গেছে, যা বিনিয়োগকারীদের আইটি খাতে কমে যাওয়া আস্থার ইঙ্গিত দেয়। বিশ্বব্যাপী চাহিদার অনিশ্চয়তা এবং ডলারের শক্তির কারণে আইটি কোম্পানিগুলিতে চাপ বেড়েছে।
ধাতু খাতে চাপের প্রধান কারণ কাঁচা তেলের দাম বৃদ্ধি এবং বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে সংকট। ইরান ও আমেরিকার সংঘাতের ফলে ক্রুড অয়েলের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে, যার ফলে ধাতু এবং অটো খাতের ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে।
বাজার বিশ্লেষকরা কী বলছেন
রেলিগেয়ার ব্রোকিং লিমিটেডের প্রধান ভাইস প্রেসিডেন্ট অজিত মিশ্রার মতে, এই সপ্তাহ ভারতীয় শেয়ার বাজারের জন্য অত্যন্ত নির্ণায়ক হতে পারে। বাজারের দিকনির্দেশনা বিশ্বব্যাপী সংকেতের উপর নির্ভর করবে, যার মধ্যে ইরান-ইসরাইল সংঘাতের অগ্রগতি, আমেরিকার অর্থনৈতিক তথ্য এবং ফেডারেল রিজার্ভের বক্তব্যে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে।
মোতিলাল ওসওয়াল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের গবেষণা প্রধান সিদ্ধার্থ খেমকার মতে, বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তিনি মনে করেন আগামী দিনগুলিতে আমেরিকার পরিষেবা এবং উৎপাদনশীলতা PMI-এর তথ্য, ডলার ইন্ডেক্সের চলাচল এবং তেলের দাম বাজারের দিক নির্ধারণ করবে।
বিনিয়োগকারীদের জন্য পরামর্শ
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হল, বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের কৌশল অটুট রাখা উচিত। বাজারে ধসকে সুযোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে, কিন্তু কেবলমাত্র সেই শেয়ারে বিনিয়োগ করা উচিত যাদের ভিত্তি শক্তিশালী এবং যাদের আয় স্থিতিশীল।
ছোট বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি সংযম এবং বিবেচনার সাথে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। বাজারে উত্থান-পতন স্বাভাবিক, কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যাপী সংকট এটিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। যে কোনও ধরণের তাড়াহুড়ো বা গুজবের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করা ক্ষতিকারক হতে পারে।
আন্তর্জাতিক স্তরে পরবর্তী পদক্ষেপ
ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি আমেরিকা এবং ইরানের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়ে, তাহলে এর প্রভাব বিশ্বের সকল বাজারে পড়বে। ভারতও এর থেকে বাদ থাকবে না। বিশেষ করে তেল আমদানির উপর নির্ভরতা এবং বাণিজ্যিক অস্থিরতার কারণে ঘরোয়া অর্থনীতিতে চাপ বেড়ে যেতে পারে।
তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে পারে, যার ফলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আর্থিক নীতির উপরও প্রভাব পড়বে। এর ফলে আগামী দিনগুলিতে সুদের হার পরিবর্তনের সম্ভাবনাও বেড়ে যেতে পারে।