স্টিভ জবস: সাধারণ শুরু, অসাধারণ সাফল্য ও অমর উত্তরাধিকার

🎧 Listen in Audio
0:00

বিশ্বে যখনই প্রযুক্তিগত বিপ্লব ও উদ্ভাবনের কথা উঠে, সবার আগে স্টিভ জবসের নামই আসে। তিনি শুধু একজন সফল উদ্যোক্তা ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি ও দূরদর্শিতার প্রতীক, যা বিশ্বের চিন্তাভাবনা ও প্রযুক্তির ব্যবহারকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছে। অ্যাপল, পিক্সার এবং ডিজনি-র মতো বিশাল ব্র্যান্ডগুলিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া স্টিভ জবসের জীবন একটি অনুপ্রেরণা, বিশেষ করে তরুণদের জন্য, যারা নিজের পথ নিজেই তৈরি করতে চায়।

সাধারণ শুরু, অসাধারণ চিন্তা

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো শহরে জন্মগ্রহণকারী স্টিভ জবসকে জন্মের পরপরই দত্তক নেওয়া হয়। তার দত্তক পিতামাতা পল এবং ক্লারা জবস তাকে ভালোবাসা ও শিক্ষা দুটোই দিয়েছিলেন। পল একজন মেকানিক ছিলেন, যার কাছ থেকে স্টিভ প্রযুক্তিগত জিনিসপত্র বোঝা শিখেছিলেন। অন্যদিকে ক্লারা স্টিভকে পড়াশোনায় আগ্রহী করে তুলেছিলেন।

সেই ছোটবেলা থেকেই স্টিভ জবসের ঐতিহ্যগত পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল না। সে জিনিসপত্র তার নিজের মতো করে বুঝতে এবং করতে পছন্দ করত। এ কারণেই সে কলেজের পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখে দেয়, কিন্তু ক্যালিগ্রাফি (Calligraphy) এর মতো সৃজনশীল বিষয়ে আগ্রহ দেখায়, যা পরবর্তীকালে অ্যাপল প্রোডাক্টের ডিজাইনকে অনন্য করে তুলেছে।

ভারত ভ্রমণ ও আধ্যাত্মিক অন্বেষণ

স্টিভ জবসের চিন্তাধারা শুধুমাত্র প্রযুক্তি-নির্ভর ছিল না, তিনি গভীর আধ্যাত্মিক বোধও রাখতেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ভারত ভ্রমণ করেন এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে তিনি ভ্রমণ করেন এবং নীম কারোলি বাবার আশ্রমেও কিছু সময় কাটান। তবে, বাবার মৃত্যুর কারণে তিনি তাঁর সাথে দেখা করতে পারেননি, কিন্তু ভারত ভ্রমণ তার জীবনে বড় পরিবর্তন এনে দেয়।

এই সময়ই জবস জীবন ও সাফল্যের অর্থ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করেন। তিনি জৈন ও বৌদ্ধ দর্শন গ্রহণ করেন, যা তার ব্যক্তিগত ও পেশাগত চিন্তাধারায় প্রতিফলিত হতে থাকে।

অ্যাপলের ভিত্তি ও বিপ্লবের সূচনা

১৯৭৬ সালে স্টিভ জবস তার বন্ধু স্টিভ ওয়োজনিয়াকের সাথে মিলে ‘অ্যাপল কম্পিউটার্স’ এর ভিত্তি স্থাপন করেন। শুরুটা তাদের গ্যারেজ থেকে, যেখানে তারা প্রথম অ্যাপল I কম্পিউটার তৈরি করত। জবস এটিকে শুধু একটি মেশিন নয়, বরং একটি স্বপ্ন হিসেবে উপস্থাপন করেন।

অ্যাপল II এবং পরে ম্যাকিন্টোশ বিশ্বে একটি নতুন প্রযুক্তিগত বিপ্লবের সূচনা করে। কম্পিউটার এখন আর শুধু অফিস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সাধারণ মানুষের জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।

ব্যর্থতায় ভয় পাননি

প্রত্যেক সফল ব্যক্তির মতো স্টিভ জবসকেও ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে তাকে অ্যাপল থেকে বের করে দেওয়া হয়। কিন্তু জবস হাল ছাড়েননি। তিনি ‘নেক্সট’ নামে একটি কোম্পানি শুরু করেন, যেখানে তিনি উচ্চমানের কম্পিউটার উদ্ভাবন করেন। একই সময়ে তিনি পিক্সার নামক অ্যানিমেশন কোম্পানিকেও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান।

১৯৯৫ সালে নির্মিত ‘টয় স্টোরি’ ছবিটি জবসের প্রযোজনায় নির্মিত প্রথম অ্যানিমেশন ছবি ছিল, যা বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে।

অ্যাপলে ফিরে আসা ও উদ্ভাবনের ঢেউ

১৯৯৭ সালে যখন অ্যাপল আর্থিক সংকটে ছিল, তখন কোম্পানি জবসকে ফিরিয়ে আনে। এই সময়ই জবস ‘থিঙ্ক ডিফারেন্ট’ -এর স্লোগান দেন এবং অ্যাপলকে আবার উদ্ভাবনের পথে নিয়ে আসেন। তিনি iMac, iPod, iTunes, iPhone এবং iPad এর মতো পণ্য উন্মোচন করেন, যা প্রযুক্তিকে সহজ, সুন্দর এবং সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য করে তোলে।

স্টিভ জবসের নেতৃত্বে অ্যাপল শুধু একটি টেক কোম্পানি হয়ে থাকে না, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক আইকনে পরিণত হয়।

ব্যক্তিগত জীবন ও সরলতার প্রতি আসক্তি

স্টিভ জবসের ব্যক্তিগত জীবনও তার ব্যক্তিত্বের মতোই সরল ও অনুপ্রেরণামূলক ছিল। ১৯৯১ সালে তিনি লরেন পাওয়েলের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের তিনটি সন্তান হয়। জবস সবসময় সরলতায় বিশ্বাস করতেন। তিনি জিন্স ও কালো টি-শার্ট পরতেন এবং তার চিন্তাধারায় সম্পূর্ণ স্পষ্টতা রাখতেন।

শেষ জীবন ও অমর চিন্তা

২০০৩ সালে স্টিভ জবসকে প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার হয়। রোগের সাথে লড়াই করে তিনি অ্যাপলে তার দায়িত্ব পালন করে চলেন এবং ২০০১ সালে তিনি CEO পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ৫ অক্টোবর ২০১১ সালে তার মৃত্যু হয়।

তার শেষ বাক্যগুলিতে তিনি জীবনের সত্য বর্ণনা করে বলেছিলেন—

‘যখন আপনি আপনার শেষ জীবনের জন্য যথেষ্ট টাকা উপার্জন করে ফেলেছেন, তখন আপনাকে সম্পর্ক, শিল্প ও শৈশবের স্বপ্নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ক্রমাগত টাকা উপার্জন করার অভ্যাস আপনাকে আমার মতো একজন বিকৃত মানুষ করে তুলতে পারে।’

অমর অনুপ্রেরণা

স্টিভ জবস যদিও আজ শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার চিন্তা, পণ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি আজও বিশ্বের তরুণদের অনুপ্রেরণা জোগায়। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন যে, ব্যর্থতাও সাফল্যের সিঁড়ি হতে পারে, যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক হয়।

তার জীবন এই বার্তা দেয়—

  • সবসময় আলাদা ভাবো।
  • প্যাশনের পিছনে ছুটো, টাকা আপনা আপনি আসবে।
  • সরলতাতেই আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে।
  • যদি পৃথিবী বদলাতে হয়, তাহলে নিজের থেকে শুরু করতে হবে।

স্টিভ জবস একজন এমন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি প্রযুক্তিকে শুধু ব্যবসা নয়, বরং একটা শিল্প করে তুলেছিলেন। তিনি একজন চিন্তাবিদ, একজন শিল্পী এবং একজন দূরদর্শী ছিলেন, যার জীবন এই প্রমাণ করে যে, উৎসাহ, আত্মবিশ্বাস ও স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে যে কেউ বিশ্ব বদলে দিতে পারে। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তার চিন্তা ও পণ্য সর্বদা মানবতার জন্য প্রদীপস্তম্ভের মতো কাজ করে যাবে।

Leave a comment