মোহাম্মদ রফি: ভারতীয় চলচ্চিত্র সংগীতের অমর কণ্ঠশিল্পী

🎧 Listen in Audio
0:00

ভারতীয় চলচ্চিত্র সংগীতের ইতিহাসে এক নাম এমন রয়েছে, যার কণ্ঠস্বর শুধুমাত্র অন্তরকে ছুঁয়ে যায়নি, বরং প্রতিটি যুগের আবেগকে সুর দিয়ে চিরস্থায়ী করে রেখেছে। সেই নাম হল—মোহাম্মদ রফি। তাকে রফি সাহেব অথবা শাহেনশাহ-এ-তরণ্ণুম নামেও পরিচিত। রফি সাহেবের মধুর এবং আবেগে পরিপূর্ণ কণ্ঠস্বর বলিউডের অনেক তারকাকে পর্দায় নতুন পরিচয় দিয়েছে। ২৪ ডিসেম্বর ১৯২৪ সালে জন্মগ্রহণকারী রফি সাহেব তার জীবনে প্রায় ৫০০০-এর বেশি গান গেয়েছেন এবং প্রতিটি ধারায় নিজেকে প্রমাণ করেছেন।

শৈশবের এক কণ্ঠস্বর থেকে জন্ম নেওয়া স্বরসাধক

রফি সাহেবের শৈশব কেটেছে লাহোরে, যেখানে তাঁর পরিবার জীবিকার সন্ধানে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। তাঁর পরিবারের সংগীতের সাথে কোনো বিশেষ সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু রফির আত্মা সংগীতের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল। বলা হয়, সাত বছর বয়সে এক ফকিরের গানের কণ্ঠস্বর তাকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে সে তার অনুকরণ করতে শুরু করে। এই ধারাবাহিকতা নাইয়ের দোকান থেকে শুরু হয়েছিল এবং পরে পাড়ার মানুষের মধ্যে তার মধুরতার কথা ছড়িয়ে পড়ে।

তার বড় ভাই মোহাম্মদ হামিদ তার প্রতিভাকে চিনে নিয়ে তাকে উস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খানের কাছে সংগীত শিক্ষা দান করেন। একদিন যখন অল ইন্ডিয়া রেডিও লাহোরে কে.এল. সেহগলের অনুষ্ঠান ছিল এবং বিদ্যুৎ চলে গেল, তখন জনতার অস্থিরতা দেখে আয়োজকরা রফিকে গান গাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। এটিই ছিল তার প্রথম জনসাধারণের সামনে উপস্থাপনা—যেখানে সংগীতকার শ্যাম সুন্দরও উপস্থিত ছিলেন এবং রফির প্রতিভায় অত্যন্ত মুগ্ধ হন।

চলচ্চিত্র জীবনের সূচনা

রফি সাহেবের প্রথম চলচ্চিত্র গান ছিল ১৯৪৪ সালে পাঞ্জাবি চলচ্চিত্র 'গুল বালোচ'-এর জন্য। এর পর তিনি মুম্বাই যান এবং ১৯৪৬ সালে নওশাদ সাহেবের চলচ্চিত্র 'পেহলে আপ'-এ গান গাওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু স্বীকৃতি পান 'অনমোল ঘড়ি' (১৯৪৬) চলচ্চিত্রের 'তেরা খিলোনা টুটা বালক' গানের মাধ্যমে।

নওশাদ, শঙ্কর-জয়কিশন, ও.পি. নায়ার, সচিন দেব বর্মণ, মদন মোহন, রবি এবং লক্ষ্মীকান্ত-পিয়ারেলাল প্রভৃতি दिग्गज সংগীতকাররা বারবার রফির কণ্ঠস্বর বেছে নিয়েছেন। এক সময় এমন অবস্থা এসেছিল যে প্রায় প্রতিটি প্রধান অভিনেতার জন্য পার্শ্বগায়ক হিসেবে প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছিলেন মোহাম্মদ রফি।

সংগীতের উচ্চতায় পৌঁছানো

১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত রফি সাহেবের সোনালী সময় কেটেছে। চলচ্চিত্রে তাঁর গাওয়া গানের দীর্ঘ তালিকা থেকে কিছু আজও চিরস্থায়ী—যেমন 'ও দুনিয়া কে রক্ষাওয়ালে', 'তেরি পিয়ারি পিয়ারি সুরত কো', 'চাহুঙ্গা মেই তুঝে সাঞ্ঝ সবেড়ে', 'বাহারোঁ ফুল বারসাও', 'লিখে যো খাত তুঝে' এবং 'য়ে রেশমি জুলফেন'।

শম্মি কাপুর এতটাই রফির কণ্ঠস্বরের দিবানী ছিলেন যে তিনি বলেছিলেন, “আমার অভিনয়ে যে জীবন দেখা যায়, তা রফির কণ্ঠস্বরের কারণে।” চাই 'চাহে কয়ি মুঝে জঙ্গলি কহে' হোক বা 'দিওয়ানা হুয়া বাদল', রফির কণ্ঠস্বর শম্মি কাপুরের অভিনয়ে প্রাণ দিয়ে দিত।

ফিল্মফেয়ার এবং পদ্মশ্রী সম্মান

রফি সাহেব তার জীবদ্দশায় অনেক সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৬০ সালে 'চৌদাহবি কা চাঁদ' চলচ্চিত্রের শিরোনাম গানের জন্য তিনি প্রথম ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান। এরপর 'তেরি পিয়ারি পিয়ারি সুরত' (১৯৬১), 'বাহারোঁ ফুল বারসাও' (১৯৬৬), 'চাহুঙ্গা মেই তুঝে' (১৯৬৫), 'কিয়া হুয়া তেরা ওয়াদা' (১৯৭৭) প্রভৃতি গানের জন্য তাকে আরও পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ভারত সরকার ১৯৬৫ সালে তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে।

রফি সাহেবের বিশেষত্ব

রফি সাহেবের কণ্ঠস্বরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা নির্মলতা, রোমান্স, ব্যথা এবং ভক্তি। তাঁর গায়কিতে পারফেকশনের সাথে সাথে এক আধ্যাত্মিক গভীরতা ছিল। যত সহজে তিনি 'মধুবনে রাধিকা নাচে রে' গাইতে পারতেন, ততই তীব্রতার সাথে 'কর চলে হাম ফিদা' এর মতো দেশাত্মবোধক গানও গাইতে পারতেন।

তিনি গায়ক ছিলেন না, শিল্পী ছিলেন যারা তাদের কণ্ঠস্বর দিয়ে দৃশ্যকে জীবন্ত করে তুলতেন। यही কারণে দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র, রাজেন্দ্র কুমার থেকে শুরু করে অমিতাভ বচ্চন এবং ঋষি কাপুর পর্যন্ত—প্রতিটি অভিনেতা তাঁর কণ্ঠস্বরকে তাদের অভিনয়ের পরিপূরক বলে মনে করতেন।

এক যুগের অবসান, কিন্তু স্বর অমর

৩১ জুলাই ১৯৮০ সালে রফি সাহেব এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তাঁর শেষকৃত্যে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল। পুরো দেশে এক গভীর নীরবতা নেমে এসেছিল। যেন স্বর থেমে গেছে।

যদিও তাঁর শারীরিক উপস্থিতি চলে গেছে, কিন্তু তাঁর সংগীত আজও প্রতিটি অন্তরের স্পন্দন। ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে তাঁর ৯৩তম জন্মদিনে Google একটি ডুডল তৈরি করে তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানায়, যা মুম্বাইয়ের চিত্রশিল্পী সাজিদ শেখ ডিজাইন করেছিলেন।

প্রেরণা হয়ে আজও জীবন্ত রয়েছে রফির কণ্ঠস্বর

রফি সাহেবের গায়কী সোনু নিগম, মোহাম্মদ আজিজ, উদিত নারায়ণ প্রভৃতি গায়কদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। যদিও এরা সবাই নিজের একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করেছে, কিন্তু তারা নিজেরাই স্বীকার করে যে রফির মতো কেউ নেই।

আজ যখনই কোনো নতুন গায়ক তার কণ্ঠস্বর দিয়ে অন্তর জয় করে, তখন সেখানে কখনো না কখনো রফির ছায়া অবশ্যই থাকে। তাঁর গান আজও নতুন চলচ্চিত্রে রিমিক্স হয়, রেডিওতে বাজে এবং পুরোনো সংগীতপ্রেমীদের অন্তরে জীবন্ত রয়েছে।

মোহাম্মদ রফি এমন একজন শিল্পী ছিলেন, যার কণ্ঠস্বর প্রতিটি আবেগকে জীবন্ত করে তুলেছিল। তিনি যদিও আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর আজও অন্তরে বসবাস করছে। তিনি তার গায়কীর মাধ্যমে শুধুমাত্র मनोरंजन করেননি, বরং ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি প্রতিটি সংগীতপ্রেমীর অন্তরে আজও জীবন্ত—একজন অমর গায়ক হিসেবে।

Leave a comment