চিনাব সেতু: বন্দে ভারত ট্রেনের কাশ্মীরে আগমন এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ রেল সেতুর গল্প

🎧 Listen in Audio
0:00

চিনাব সেতু দিয়ে প্রথমবার কাশ্মীরে পৌঁছেছে ভারতের বন্দে ভারত ট্রেন। ঘোড়া-খচ্চরের সাহায্যে শুরু হওয়া এই সেতু এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ রেল সেতুতে পরিণত হয়েছে।

চিনাব সেতু: চিনাব সেতুর নির্মাণ ভারতীয় প্রকৌশলের জন্য একটি ঐতিহাসিক সাফল্য। ঘোড়া-খচ্চরের সাহায্যে শুরু হওয়া এই প্রকল্প আজ কাশ্মীরে রেলপথ সংযোগ স্থাপন করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কর্তৃক উদ্বোধন করা এই সেতু বন্দে ভারত ট্রেনকে শ্রীনগরে পৌঁছে দিয়েছে। আসুন জেনে নেই এই সেতুর পিছনে লুকিয়ে থাকা অজানা গল্প।

কাশ্মীরে রেল নেটওয়ার্ক সংযোগের ঐতিহাসিক উদ্যোগ

ভারতে রেল যোগাযোগ নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প চালু হয়েছে, কিন্তু কাশ্মীরে দেশের অন্যান্য অংশের সাথে রেলপথের মাধ্যমে সংযোগ স্থাপনের স্বপ্ন কয়েক দশকের পুরোনো। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়নে চিনাব সেতু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

এই সেতু কেবলমাত্র একটি প্রযুক্তিগত কাঠামো নয়, বরং ভারতের প্রকৌশলীদের পরিশ্রম, সংকল্প এবং অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার গল্প। এই সেতু উধমপুর-শ্রীনগর-বারামুলা রেল লিঙ্ক (USBRL) প্রকল্পের অংশ, যা এখন সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত।

পাহাড়ে কীভাবে পৌঁছেছে নির্মাণ সামগ্রী?

চিনাব সেতুর নির্মাণস্থল হিমালয়ের খাড়া ঢালে ঘেরা, যেখানে সাধারণ যানবাহন বা যন্ত্রপাতি দিয়ে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব ছিল। তাই প্রথম প্রশ্নই ছিল, নির্মাণ সামগ্রী, যন্ত্রপাতি এবং কর্মীদের সেখানে কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যাবে?

উত্তর হলো - ঘোড়া এবং খচ্চর। প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে, ঘোড়া এবং খচ্চরের সাহায্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাহাড়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। ধীরে ধীরে অস্থায়ী রাস্তার নির্মাণ করা হয়েছিল যাতে যন্ত্রপাতি এবং ভারী সামগ্রীও সেখানে পৌঁছাতে পারে।

বিশ্বের সর্বোচ্চ রেল সেতু

চিনাব সেতু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৫৯ মিটার উঁচু, যা এটিকে চিনাব নদীর উপর বিশ্বের সর্বোচ্চ রেল সেতু করে তুলেছে। এই উচ্চতা প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের চেয়েও ৩৫ মিটার বেশি। এই সেতুর আর্চ (arch) প্রকৌশলের এমন একটি নমুনা, যা দেখে বিশ্বের বিশেষজ্ঞরাও অবাক হয়েছেন।

আধুনিক প্রযুক্তির অতুলনীয় ব্যবহার

  • এফকন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড এই সেতুর নির্মাণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে।
  • বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্রসবার কেবল ক্রেন
  • বিশেষ ধরণের ভারী যন্ত্রপাতি

সমেকন গ্রাউটিং (Consolidation Grouting)

এই প্রযুক্তিগুলির সাহায্যে পাহাড়ের ঢালগুলি স্থির করা হয়েছিল, যাতে সেতুর ভিত্তি শক্তিশালী হতে পারে। উভয় পাশ থেকে আর্চ ক্যান্টিলিভার প্রযুক্তির মাধ্যমে ধীরে ধীরে যুক্ত করা হয়েছিল। ৫ এপ্রিল, ২০২১ এ সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত এসেছিল যখন উভয় পাশের আর্চ পরস্পরের সাথে মিলিত হয়েছিল।

সেতু নির্মাণের প্রধান পর্যায়

পৌঁছানোর পথ স্থাপন: প্রথমে অস্থায়ী পথের মাধ্যমে সাইটে পৌঁছানো হয়েছিল। পরবর্তীতে, উভয় দিকে ১১ এবং ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থায়ী রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল।

আর্চ নির্মাণ: উভয় দিক থেকে আর্চ একত্রিত করার জন্য ক্যান্টিলিভার পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল।

ভায়াডাক্ট নির্মাণ: আরেকটি প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ, যা চারটি পর্যায়ে সাবধানতার সাথে সম্পন্ন হয়েছিল।

মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা: প্রথমবারের মতো কোনও ভারতীয় রেল প্রকল্পে NABL কর্তৃক অনুমোদিত ল্যাব ব্যবহার করা হয়েছিল যাতে প্রতিটি পর্যায়ে গুণমানের নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

জাতি গঠনের দৃষ্টান্ত

এফকন্সের এমডি এস পরমসিবন বলেছেন যে এই প্রকল্প ভারতের দুর্গম এলাকায় অবকাঠামো তৈরির ক্ষমতার প্রতীক। এটি আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা যে ভারতীয় প্রকৌশলীরা কী করতে পারে।

কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট কৃষ্ণমূর্তি সুব্রমণ্যমের মতে, এই সেতু সাহস এবং প্রযুক্তির মেলবন্ধন, যা দেখায় যে যদি উদ্দেশ্য দৃঢ় হয় তবে কোনও চ্যালেঞ্জই বড় নয়।

বন্দে ভারত ট্রেনের শ্রীনগরে প্রবেশ

চিনাব সেতুর উদ্বোধনের সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বন্দে ভারত ট্রেনকে সবুজ সংকেত দেখিয়েছেন, যা এখন কাটড়া থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত চলবে। এটি একটি বড় সাফল্য, কারণ এই ট্রেন এখন ভারতের সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এলাকাকে সরাসরি রেলযোগে সংযুক্ত করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

প্রধানমন্ত্রী মোদী চিনাব সেতুতে উপস্থিত ছিলেন এবং ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলন করে সেতুতে হেঁটে গেছেন। তিনি রেল ইঞ্জিনের ডিব্বিতে বসে সাইট পরিদর্শন করেছেন। এই মুহূর্তটি ভারতীয় রেল এবং প্রকৌশলী সমাজের জন্য গর্বের মুহূর্ত ছিল।

Leave a comment