সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের জীবন ও কর্ম: এক যুগের অবসান

🎧 Listen in Audio
0:00

সত্যিই, সুর কোকিল লতা মঙ্গেশকরের প্রস্থানে একটি যুগের অবসান হল, আসুন তাঁর জীবন পরিচয় থেকে আপনাকে পরিচিত করাই

লতা মঙ্গেশকর ভারতের সবচেয়ে প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় গায়িকা, যাঁর ছয় দশকের দীর্ঘ কর্মজীবন সাফল্যে পরিপূর্ণ। যদিও লতাজি প্রায় ত্রিশটি ভাষায় গান গেয়েছেন, তবে তাঁর পরিচিতি ভারতীয় সিনেমার একজন প্লেব্যাক গায়িকা হিসাবে। চলচ্চিত্র জগতে গান গাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর বোন আশা ভোঁসলের সাথে তাঁর সহযোগিতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

লতা মঙ্গেশকরের প্রতিটি গানই যেন নিজের মধ্যে এক একটি শ্রেষ্ঠ কাজ। তাঁর কণ্ঠের মাধুর্য, সুর এবং গানের কথার গভীরতা এক মিষ্টি ও আকর্ষনীয়তার মিশ্রণ তৈরি করে, যা শুনলেই হৃদয়ের গভীরে অনুরণিত হয়। তাঁর গান যেন পবিত্রতার প্রতীক, যা তার মধুর সৌন্দর্যের মাধ্যমে সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে। ভারতীয় সংগীতে স্বতন্ত্রতা এবং জনপ্রিয়তার সীমা অতিক্রম করা লতাজির কণ্ঠে কমনীয়তা এবং মাধুর্যের এক বিরল সমন্বয় দেখা যায়। তাঁর গানে পবিত্রতার ঝর্ণা প্রবাহিত হয়, যা তার মধুর আকর্ষণে সবাইকে মোহিত করে। লতাজির গান শুনে সঙ্গীতের পূর্ণতা লাভ হয়। তিনি শুধুমাত্র 'দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার', 'পদ্মশ্রী' এবং 'ভারতরত্ন'-এর মতো উপাধিতেই সম্মানিত হননি, এছাড়াও তিনি আরও অনেক পুরস্কার এবং প্রশংসায় ভূষিত হয়েছেন। প্রত্যেক ভারতীয় তাঁকে নিয়ে গর্বিত।'

লতা মঙ্গেশকরের জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন

লতা মঙ্গেশকর ১৯২৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা, দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন একজন মারাঠি থিয়েটার অভিনেতা, সঙ্গীত পরিচালক এবং গায়ক। লতা মঙ্গেশকরের মায়ের নাম ছিল শেভন্তি মঙ্গেশকর। তাঁর ভাইয়ের নাম হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর, যিনি একজন সঙ্গীত পরিচালক। লতা মঙ্গেশকরের বোনেরা হলেন ঊষা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে এবং মীনা খাদিকর, তাঁরা সকলেই প্লেব্যাক গায়িকা। লতা মঙ্গেশকরের নাম ভূপেন হাজারিকার সাথে অনেকবার যুক্ত হয়েছিল, কিন্তু তিনি কখনও বিয়ে করেননি।

লতা মঙ্গেশকরের কর্মজীবন

লতা মঙ্গেশকর ভারত তথা বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সম্মানিত প্লেব্যাক গায়িকাদের মধ্যে একজন। মহান গায়িকা লতা মঙ্গেশকর এক হাজারের বেশি হিন্দি সিনেমার জন্য গান রেকর্ড করেছেন। লতা মঙ্গেশকরের মখমলের মতো, মিষ্টি এবং সুরেলা কণ্ঠ তাঁর জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। তিনি তাঁর বাবার কাছে সঙ্গীতের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। যখন লতার বয়স পাঁচ বছর ছিল, তখন তিনি তাঁর বাবার নাটকে অভিনেত্রী হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন। লতা মঙ্গেশকর ১৯৪২ সালে ১৩ বছর বয়সে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি মারাঠি চলচ্চিত্র "কিতি হাসাল"-এর জন্য তাঁর প্রথম গান রেকর্ড করেছিলেন। লতা মঙ্গেশকর বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় ৩০,০০০-এর বেশি গান গেয়েছেন। তিনি ভারতীয় সিনেমার সর্বশ্রেষ্ঠ গায়িকাদের মধ্যে একজন হিসাবে বিবেচিত হন এবং ২০০১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার, ভারতরত্ন লাভ করেন।

হার্দিকার থেকে মঙ্গেশকর

পণ্ডিত দীননাথের পদবি ছিল হার্দিকার, যা তিনি পরিবর্তন করে মঙ্গেশকর রাখেন। তাঁরা গোয়ার মঙ্গেশিতে থাকতেন, যেখান থেকে তাঁর নতুন পদবি অনুপ্রাণিত। জন্মের সময় লতার নাম ছিল হেমা, যা পরিবর্তন করে লতা রাখা হয়। দীননাথ তাঁর নাটক 'ভাববন্ধন'-এর চরিত্র লতিকার নামানুসারে এই নামটি রেখেছিলেন। লতার পরে মিনা, আশা, ঊষা এবং হৃদয়নাথের জন্ম হয়।

মধুর সৌন্দর্যের ঢেউয়ে ডুবে থাকা লতাজির গান এতটাই জাদুকরী যে, কানে আসা মাত্রই গানের সম্পূর্ণ অর্থ তার গভীর অনুভূতি দিয়ে অনুভব করা যায়। প্রজাতন্ত্র দিবসে যখন লতা প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সামনে আবেগপূর্ণ দেশাত্মবোধক গান "অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগো" গেয়েছিলেন, তখন তিনি তাঁর চোখের জল আটকাতে পারেননি। তা ভালোবাসা হোক, বিচ্ছেদ হোক, পুনর্মিলন হোক, ভক্তি হোক, দেশপ্রেম হোক বা জীবনের অন্য কোনো অনুভূতি হোক, লতাজি সকলের সাথেই সুবিচার করেছেন।

সম্মান ও পুরস্কার

লতা মঙ্গেশকর অনেক পুরস্কার ও সম্মান পেয়েছেন। ১৯৭০ সালের পর তিনি যত পুরস্কার গ্রহণ করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি সেরা প্লেব্যাক গায়িকার পুরস্কার এই যুক্তিতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে, এটি নতুন গায়কদের দেওয়া উচিত। লতা মঙ্গেশকরকে দেওয়া কিছু প্রধান পুরস্কার এবং সম্মান নিচে দেওয়া হল:

ভারত সরকার পুরস্কার

১৯৬৯ - পদ্মভূষণ

১৯৮৯ - দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার

১৯৯৯ - পদ্মবিভূষণ

২০০১ - ভারতরত্ন

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

১৯৭২ - চলচ্চিত্র "পরিচয়"-এর গানের জন্য শ্রেষ্ঠ মহিলা প্লেব্যাক গায়িকার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

১৯৭৪ - চলচ্চিত্র "কোরা কাগজ"-এর গানের জন্য শ্রেষ্ঠ মহিলা প্লেব্যাক গায়িকার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

১৯৯০ - চলচ্চিত্র "লেকিন"-এর গানের জন্য শ্রেষ্ঠ মহিলা প্লেব্যাক গায়িকার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

ফিল্মফেয়ার পুরস্কার

১৯৫৯ - "আজারে পরদেশী" (মধুমাতি)

১৯৬৩ - "কাহে দিয়া পরদেশ" (অনপড়)

১৯৬৬ - "তুম মেরে মন্দির তুম মেরি পূজা" (খানদান)

১৯৭০ - "আপ মুঝে আচ্ছে লগনে লগে" (জিনে কি রাহ)

১৯৯৩ - ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার

১৯৯৪ - গান "দিদি তেরা দেবর দিওয়ানা" (হাম আপকে হ্যায় কৌন..!) এর জন্য বিশেষ পুরস্কার।

২০০৪ - ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কার: ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি স্বর্ণালী ট্রফি প্রদান করা হয়।

লতা মঙ্গেশকরের প্রেমের গল্প

লতাজি চিরজীবন অবিবাহিত ছিলেন, তবে শোনা যায়, ডুঙ্গারপুরের রাজপরিবারের রাজ সিং-এর সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। তাঁরা দুজনেই একে অপরের সাথে খুব ভালোবাসতেন, কিন্তু রাজা হওয়ার কারণে রাজ সিং তাঁর পরিবারের প্রতিজ্ঞা দ্বারা আবদ্ধ ছিলেন যে তিনি কোনো সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করবেন না, যা তিনি বিশ্বস্ততার সাথে পালন করেছিলেন এবং দুজনেই চিরজীবন অবিবাহিত থেকে যান।

মহম্মদ রফি সাহেব দ্বারা গাওয়া কালজয়ী গান,

'তুম মুঝে ইউঁ ভুলা না পাওগে...!

হ্যাঁ তুম মুঝে ইউঁ ভুলা না পাওগে...!

যব কভি ভি সুনোগে গীত মেরে...!

সঙ্গ সঙ্গ তুম ভি গুনগুনাওগে...!

হ্যাঁ তুম মুঝে ইউঁ ভুলা না পাওগে...

হো তুম মুঝে ইউঁ ... ..

অশ্রুসিক্ত বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

```

Leave a comment