মহাভারত ভারতের এক অসাধারণ মহাকাব্য, যাতে ধর্ম, নীতি ও যুদ্ধের বহু কাহিনী সমাহিত রয়েছে। এই যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ধর্ম ও অধর্মের মধ্যে সংঘর্ষ। এই যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকা শুধুমাত্র একজন সারথির ভূমিকায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তিনি যুদ্ধের কৌশল ও নীতি দিয়ে পান্ডবদের বিজয়ী করে তোলার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কখনও যুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র তুলে ধরেননি, কিন্তু তাঁর বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও জ্ঞানের দ্বারা পান্ডবরা মহাভারতের যুদ্ধ জিতেছিল। আসুন জেনে নেই কীভাবে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও দৈবিক কৌশল দিয়ে পান্ডবদের বিজয় এনে দিয়েছিলেন।
অর্জুনের সারথি থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রণনৈতিক গুরু হয়ে ওঠার পথ
মহাভারত যুদ্ধের সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সারথির ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু এই ভূমিকা শুধুমাত্র রথ চালানোতে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি অর্জুনকে গীতার মাধ্যমে জীবনের সর্বোচ্চ জ্ঞান দান করেছিলেন। ভগবান কৃষ্ণের উপদেশ অর্জুনের মনে উঠে আসা সন্দেহ ও মোহ দূর করে তাকে যুদ্ধে ধর্মের জন্য লড়াই করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল। এই গীতার উপদেশ মহাভারত যুদ্ধের পাশাপাশি মানবজীবনের জন্যও একটি অমর দিকনির্দেশনা হয়ে রয়েছে।
দুর্যোধনের বজ্রবন্ধন কীভাবে দুর্বল করা হয়েছিল?
মহাভারতে দুর্যোধন অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর মাতা গান্ধারী ভগবান শিব থেকে বর পেয়েছিলেন যে, তিনি যার উপর দৃষ্টিপাত করবেন সে বজ্রের মতো অজেয় হয়ে উঠবে। গান্ধারী তাঁর দৃষ্টি দিয়ে দুর্যোধনের দেহকে অজেয় করে তুলেছিলেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৌশল একেও দুর্বল করে দিয়েছিল। কৃষ্ণ দুর্যোধনকে তাঁর মায়ের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। দুর্যোধন তাঁর নিম্নভাগ ঢেকে রেখেছিলেন, যার ফলে সেই অংশ বজ্রবন্ধন হয়ে উঠেনি এবং নিম্নভাগ দুর্বল থেকে গেছে। অবশেষে যুদ্ধে ভীম দুর্যোধনের এই দুর্বল অংশে আঘাত করে তাকে পরাজিত করেছিলেন। এই ঘটনা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রণনৈতিক বুদ্ধিমত্তার প্রতীক।
ভীষ্ম পিতামহের বিরুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধিমত্তা
ভীষ্ম পিতামহ মহাভারতের সবচেয়ে মহান যোদ্ধা এবং পান্ডবদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিলেন। তাঁর পরাজয় ছাড়া পান্ডবদের বিজয় সম্ভব ছিল না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের রথে শিখণ্ডিকে বসিয়েছিলেন, যিনি পূর্বজন্মে অম্বা রূপে নারী ছিলেন। ভীষ্ম, যিনি নারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন না, শিখণ্ডিকে দেখে অস্ত্র ধরেননি। এই সুযোগে অর্জুন ভীষ্মের উপর বাণবর্ষণ করে তাকে বাণশয্যায় শায়িত করেছিলেন। এই কৌশল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দূরদর্শিতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
দ্রোণাচার্যের বধের জন্য শ্রীকৃষ্ণের রণনৈতিক খেলা
দ্রোণাচার্য পান্ডবদের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যোদ্ধা ছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর উপস্থিতি পান্ডবদের জন্য হুমকি ছিল। কৃষ্ণ দ্রোণাচার্যকে দুর্বল করার জন্য একটি মায়া রচনা করেছিলেন। যুদ্ধের সময় ভীম অশ্বত্থামা নামক হস্তির বধ করে জোরে জোরে বলেছিলেন যে, ‘অশ্বত্থামা মারা গেছে।’ এ কথা শুনে দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরের কাছে এর সত্যতা জানতে চেয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির সত্য কথার প্রথা পালন করে বলেছিলেন যে, অশ্বত্থামা মারা গেছে, কিন্তু চালাকি করে শুধুমাত্র হস্তির মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছিলেন। এ কথা শুনে দ্রোণাচার্য তাঁর পুত্রের মৃত্যু মনে করে দুঃখে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। এই সুযোগে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর বধ করেছিলেন। এটিও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধনীতি ও বুদ্ধিমত্তার গাথা।
জয়দ্রথ বধে শ্রীকৃষ্ণের মায়ার কার্যকরীতা
যখন অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি সূর্যাস্তের আগে জয়দ্রথের বধ করবেন, তখন কৌরবরা জয়দ্রথকে লুকিয়ে রেখেছিল এটিকে ব্যর্থ করার জন্য। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মায়ার মাধ্যমে সূর্যগ্রহণের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন। এতে জয়দ্রথ মনে করেছিলেন যে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এবং তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন। ঠিক সেই সময় গ্রহণ কেটে গেল এবং অর্জুন জয়দ্রথের বধ করে তাঁর প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করেছিলেন। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, কৃষ্ণ যুদ্ধের নিয়মের সম্মান রেখেও বিজয়ের জন্য নীতিগত কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া যুদ্ধে বিজয় সম্ভব ছিল না
মহাভারতের যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কখনও অস্ত্র তুলেননি, কিন্তু তাঁর ভূমিকা থেকে এটি স্পষ্ট হয় যে, যুদ্ধ শুধুমাত্র বল প্রয়োগে নয়, বরং বুদ্ধি, নীতি ও ধর্মের জ্ঞান দিয়েও জিতে যায়। তাঁর উপস্থিতি পান্ডবদের জন্য পথপ্রদর্শক, শিক্ষক ও রক্ষাকর্তার ছিল। কৃষ্ণের যুদ্ধনীতি ধর্মের রক্ষা করেছিল এবং অধর্মকে পরাজিত করেছিল।
মহাভারত যুদ্ধ শুধুমাত্র একটি যুদ্ধ ছিল না, বরং এটি ধর্ম ও অধর্মের সংঘর্ষের প্রতীক ছিল। এই সংঘর্ষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকা অতুলনীয় ছিল। তিনি অস্ত্র তোলার ছাড়াই পান্ডবদের যুদ্ধ জিতিয়ে দিয়েছিলেন এবং ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর জ্ঞান, তাঁর রণনীতি এবং তাঁর দৈবিক চালাকি আজও আমাদের শিক্ষা দেয় যে, কঠিন পরিস্থিতিতে বুদ্ধি ও নীতির আশ্রয় নেওয়া কতটা প্রয়োজন।