দেবশয়নী একাদশী ২০২৫: তিথি, পূজা পদ্ধতি ও গুরুত্ব

🎧 Listen in Audio
0:00

হিন্দু ধর্মে একাদশী তিথিগুলি ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত, কিন্তু দেবশয়নী একাদশীর (Devshayani Ekadashi) একটি বিশেষ ও গূঢ় গুরুত্ব আছে। একে আষাঢ় শুক্ল একাদশীও বলা হয় এবং এই দিন থেকে চাতুর্মাসের শুরু হয়। এই বছর এই পবিত্র তিথি ৬ জুলাই ২০২৫ তারিখে পালিত হবে। এই দিন ভগবান বিষ্ণু ক্ষীরসাগরে শেষনার শয্যায় যোগনিদ্রায় প্রবেশ করেন, যা চার মাস ধরে চলে।

এই একাদশী শুধুমাত্র ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত শুভ বলেই মনে করা হয় না, বরং এর সাথে যুক্ত ঐতিহ্য, ব্রহ্মাণ্ডীয় চক্র এবং তপ-ত্যাগের भावना একে আরও বিশেষ করে তোলে। আসুন জেনে নেই এই দিনের সম্পূর্ণ তথ্য—পূজা পদ্ধতি, শুভ মুহূর্ত, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং চাতুর্মাসের গভীরতা।

দেবশয়নী একাদশী ২০২৫: তিথি ও মুহূর্ত

  • একাষী তিথি আরম্ভ: ৫ জুলাই ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৫৮ টা
  • একাষী তিথি সমাপ্তি: ৬ জুলাই ২০২৫ রাত ৯:১৪ টা
  • ব্রত ও পূজনের তিথি: ৬ জুলাই ২০২৫ (রবিবার)
  • পারণ (ব্রত ভাঙ্গা) এর সময়: ৭ জুলাই সূর্যোদয়ের পর

এই দিন উপবাস ও পূজন করলে মনোকামনা পূর্ণ হয়, মানসিক শান্তি এবং মোক্ষ লাভ হয়।

দেবশয়নী একাদশীর ধর্মীয় গুরুত্ব

দেবশয়নী একাদশী থেকে ভগবান বিষ্ণুর যোগনিদ্রা শুরু হয়, যা চার মাস ধরে—অর্থাৎ প্রবোধিনী একাদশী (এইবার ২ নভেম্বর ২০২৫) পর্যন্ত চলে। একে চাতুর্মাস বলে। এটি সেই সময় যখন সৃষ্টির পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণু বিশ্রাম করেন এবং জগতের দায়িত্ব ভগবান শিব এবং অন্যান্য দেবগণ নেন।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই সময়ে:

  • বিবাহ, গৃহপ্রবেশ, মুণ্ডন, নামকরণ ইত্যাদি মঙ্গলকর কাজ নিষিদ্ধ।
  • শুধুমাত্র পাঠ, ধ্যান, জপ, তপ, তীর্থ-স্নান এবং দানের কাজ শুভ বলে মনে করা হয়।
  • ঋষি-মুনি ও সন্ত এই কাল তপস্যা ও সাধনারূপে কাটান।

দেবশয়নী একাদশীর পূজা পদ্ধতি

  1. প্রাতঃ ব্রহ্মমুহূর্তে উঠে স্নান করে হলুদ বস্ত্র পরিধান করুন।
  2. ঘরের পূজা স্থান পরিষ্কার করে হলুদ কাপড় বিছিয়ে ভগবান বিষ্ণুর মূর্তি বা ছবি স্থাপন করুন।
  3. হাতে জল, ফুল, চাল এবং ফল নিয়ে ব্রতের সংকল্প করুন— 'ॐ विष्णवे नमः, अहं विष्णोः एकादशी व्रतमहं करिष्ये।'
  4. ভগবান বিষ্ণুকে পঞ্চামৃত (দুধ, দই, ঘি, মধু, চিনি) এবং শুদ্ধ জল দিয়ে স্নান করান।
  5. তাকে চন্দন, তুলসীপাতা, হলুদ ফুল, ধূপ-দীপ, ফল, সুপারি এবং পানের পাতা অর্পণ করুন।
  6. ঘি-এর প্রদীপ জ্বালিয়ে শ্রী বিষ্ণুসহস্রনাম বা বিষ্ণুস্তোত্র পাঠ করুন।
  7. দেবশয়নী একাদশী ব্রতকথা শুনুন এবং অন্যদেরকেও শুনান।
  8. অন্তে শ্রীহরি বিষ্ণু ও লক্ষ্মীমার আরাধনা করুন এবং ভোগ লাগান—যাতে হলুদ মিষ্টি, দুধ দিয়ে তৈরি খাবার এবং তুলসী পাতা অবশ্যই থাকবে।

চাতুর্মাসে কি করবেন এবং কি করবেন না?

করবেন

  • যত বেশি সম্ভব ভগবদভক্তি এবং ধর্মীয় পাঠ
  • দান-পুণ্য, বিশেষ করে অন্ন, বস্ত্র এবং জল দান
  • সাত্ত্বিক খাবার এবং সংযত জীবনযাপন
  • তীর্থযাত্রা, যজ্ঞ, ব্রত, নিয়মের পালন

করবেন না

  • বিবাহ, বাগদান, গৃহপ্রবেশ, মুণ্ডন ইত্যাদি শুভ কাজ
  • পেঁয়াজ-রসুন, মাংসাহার, মদ্য এবং অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার
  • অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এবং বিবাদ
  • আলস্য এবং প্রমাদ

দেবশয়নী একাদশীর কথা

প্রাচীনকালে রাজা মন্ধাতা তাঁর রাজ্যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও খরা সমস্যার সমাধান খুঁজতে মহর্ষি অঙ্গিরার সাথে পরামর্শ করেন। ঋষি তাঁকে আষাঢ় শুক্ল একাদশীর ব্রত রাখার পরামর্শ দেন। যখন রাজা ও প্রজা শ্রদ্ধাভরে এই ব্রত পালন করেন, তখন তাঁদের রাজ্যে বৃষ্টি হয়, দুর্ভিক্ষ দূর হয় এবং সমৃদ্ধি আসে। সেই থেকেই এই ব্রত অত্যন্ত ফলদায়ক ও কল্যাণকর বলে মনে করা হয়।

এই দিনের বিশেষ লাভ

  • যে জাতক এই দিন নিয়মপূর্বক উপবাস ও পূজা করে, সে ভগবান বিষ্ণুর বিশেষ কৃপা লাভ করে।
  • ঘরে সুখ-শান্তি বজায় থাকে এবং মানসিক চাপ দূর হয়।
  • এই ব্রত দ্বারা পূর্বজন্মের পাপ ক্ষয় হয় এবং জীবনে শুভ সুযোগ আসতে থাকে।
  • মোক্ষ লাভের দিকে এটি একটি উত্তম সাধনা বলে মনে করা হয়।

দেবশয়নী একাদশী শুধুমাত্র একটি উপবাস বা ধর্মীয় দিবস নয়, বরং এটি চাতুর্মাসের আধ্যাত্মিক সূচনার প্রতীক। এটি আত্মচিন্তন, ভক্তি, সেবা এবং সংযমের সময়। যে ব্যক্তি এই দিন পূর্ণ শ্রদ্ধাভরে ব্রত ও পূজন করে, তার জীবনে বিষ্ণুকৃপায় সুখ, সমৃদ্ধি এবং শান্তির বাস হয়।

Leave a comment