সোনার ঝাড়ু ও জগন্নাথ রথযাত্রা: একটি ঐতিহ্যের কাহিনী

🎧 Listen in Audio
0:00

ওড়িশার পুরীতে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় বিশাল জগন্নাথ রথযাত্রা। ২০২৫ সালের ২৭ জুন এই রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে অনুষ্ঠিত এই যাত্রা কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং ভক্তি, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক আস্থার প্রতীক। এই যাত্রার সময় অনেক প্রাচীন ও বিশেষ রীতিনীতি পালিত হয়, যার মধ্যে একটি হল—সোনার ঝাড়ু দিয়ে রথপথ পরিষ্কার করা।

সোনার ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কারের রীতি কী?

রথযাত্রার আগে যার পথ দিয়ে ভগবানের রথগুলি যাত্রা করে, সেই পথ পুরীর গজপতি রাজা নিজেই ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেন। এটি কোনো সাধারণ ঝাড়ু নয়, এর হাতল সোনার। এই রীতিকে স্থানীয় ভাষায় ‘ছেড়া পাহাড়া’ (Chhera Pahara) বলা হয়।

গজপতি রাজা খালি পায়ে এসে, মাথা নিচু করে রথগুলির চারপাশে ঝাড়ু দেন এবং জল ছিটিয়ে দেন। এই রীতি দেখায় যে ভগবানের কাছে সকলেই সমান—রাজা হোক বা সাধারণ ভক্ত।

ধর্মীয় গুরুত্ব: কেন ঝাড়ুটি সোনার?

সোনা ভারতীয় সংস্কৃতিতে সর্বদা শুভ, পবিত্র ও শক্তিশালী ধাতু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। রথপথ পরিষ্কারের জন্য সোনার ঝাড়ুর ব্যবহার ভগবানের প্রতি ভক্তদের সর্বোত্তম শ্রদ্ধা প্রকাশের প্রতীক।

  • পবিত্রতার প্রতীক: সোনা পবিত্র ধাতু হিসেবে বিবেচিত এবং দেবদেবীদের পূজায় এটি প্রধানত ব্যবহৃত হয়।
  • শ্রদ্ধার উচ্চতম স্তর: যখন রাজা নিজের হাতে সোনার ঝাড়ু দেন, তখন এটি বোঝায় যে ভক্ত তার আরাধ্যকে তার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি অর্পণ করছে।
  • সামাজিক বার্তা: একজন রাজার দ্বারা পরিষ্কার করা এটিও দেখায় যে ভগবানের কাছে সকলেই সমান। এটি সমতা, সেবা ও নম্রতার পাঠ দেয়।

ছেড়া পাহাড়া রীতির ঐতিহাসিক দিক

ছেড়া পাহাড়ার রীতি অনেক শতাব্দী ধরে চলে আসছে, যখন ওড়িশায় গজপতি বংশের শাসন ছিল। মনে করা হয় এই রীতি পালন করার ফলে গজপতি রাজাকে পুণ্যের প্রাপ্তি হয় এবং তিনি নিজেকে প্রভুর দাস মনে করেন।

আজও এই রীতিটি সম্পূর্ণ সম্মান ও নিয়মের সাথে পালিত হয়। গজপতি মহারাজ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেন এবং মন্দিরের সেবকদের সাহায্যে রথপথ পরিষ্কার করেন।

রথযাত্রার প্রধান আকর্ষণ

  • তিনটি রথের বিশাল যাত্রা— ভগবান জগন্নাথ (নন্দিঘোষ রথ), বলভদ্র (তালাধ্বজ রথ) এবং সুভদ্রা (দর্পদলন রথ) এর বিশাল রথগুলি ভক্তরা টানেন।
  • শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য— যেমন ছেড়া পাহাড়া, রথ নির্মাণ প্রক্রিয়া, বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ ইত্যাদি।
  • শত শত কিলোমিটার দূর থেকে আগত ভক্ত— দেশ-বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্ত এই যাত্রায় অংশগ্রহণ করেন।
  • ভক্তি ও উল্লাসের সম্মিলন— যাত্রার সময় শহরের পরিবেশ সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় রঙে রাঙানো থাকে।

গুণ্ডিচা মন্দিরের গুরুত্ব কী?

গুণ্ডিচা মন্দির পুরী থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং জগন্নাথ রথযাত্রার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যখন ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রা রথযাত্রায় বের হন, তখন তারা এই মন্দিরেই সাত দিন থাকেন। এই মন্দিরকে ভগবান জগন্নাথের ননীহালও বলা হয়, তাই এখানে থাকাকে অত্যন্ত পবিত্র ও বিশেষ বলে মনে করা হয়। সাত দিন পর ভগবান নিজের মূল মন্দিরে ফিরে আসেন, যাকে “বহুড়া যাত্রা” বলা হয়। এই সম্পূর্ণ রীতি ভক্তদের জন্য অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তি সম্পর্কিত।

জগন্নাথ রথযাত্রা কেবল একটি ধর্মীয় যাত্রা নয়, বরং এটি ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ভক্তির জীবন্ত উদাহরণ। সোনার ঝাড়ু দিয়ে পথ পরিষ্কারের মতো রীতিনীতি শিক্ষা দেয় যে ভগবানকে পাওয়ার জন্য মন, শরীর ও আত্মার পবিত্রতা প্রয়োজন, এবং প্রভুর পথ পরিষ্কার করা আসলে নিজের ভিতরের পথকেও পরিশুদ্ধ করা।

Leave a comment