বৃষ সংক্রান্তি ২০২৫: ধর্মীয় গুরুত্ব, পুণ্যকাল ও দানের বিধি

🎧 Listen in Audio
0:00

হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী আজকের দিন অত্যন্ত পবিত্র ও শুভ, কারণ ১৫ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে বৃষ সংক্রান্তি পালিত হচ্ছে। এই দিনটিতে সূর্যদেব তাঁর উচ্চ রাশি মেষ থেকে বৃষ রাশিতে প্রবেশ করেন। ধর্মীয়, জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে একে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।

সংক্রান্তি কালকে দান, স্নান, জপ ও তপস্যার জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে মনে করা হয়, এই কারণেই এই দিনের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। সূর্যের রাশি পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীতে নতুন এক শক্তির সঞ্চার হয় এবং একে আত্মশুদ্ধি, পুণ্য অর্জন ও ইতিবাচকতা বৃদ্ধির সুযোগ বলে মনে করা হয়।

বৃষ সংক্রান্তির ধর্মীয় গুরুত্ব

হিন্দু ধর্মে বৃষ সংক্রান্তির দিন অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয়। এই দিনে ভোরে উঠে মানুষ গঙ্গা বা অন্যান্য পবিত্র নদীতে স্নান করে এবং সূর্যদেবকে জলার্ঘ্য প্রদান করে। বিশ্বাস করা হয় এই দিনে করা প্রত্যেকটি পুণ্যকর্ম অনেকগুণ ফল দেয়। ব্রত, দান এবং সূর্যপূজার মাধ্যমে জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আসে এবং মানসিক শান্তিও লাভ হয়।

বেদের এবং পুরাণ অনুসারে, বৃষ সংক্রান্তিতে তিল, গুড়, বস্ত্র, ফল এবং জলপূর্ণ কলসী দান করলে পিতৃদোষ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এই দিনটি গ্রহশান্তি এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য অত্যন্ত শুভ। এই বিশেষ দিনটি শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে পালন করলে ইতিবাচক শক্তির সঞ্চার হয় এবং জীবনে ধর্মীয় ভারসাম্য বজায় থাকে।

বৃষ সংক্রান্তি তিথি এবং সূর্যের গোচর

২০২৫ সালে বৃষ সংক্রান্তি উৎসব ১৫ই মে পালিত হচ্ছে। এটি সেই বিশেষ দিন যখন সূর্যদেব তাঁর বর্তমান রাশি মেষ ছেড়ে বৃষ রাশিতে প্রবেশ করেন।

এই বার সূর্যের গোচর রাত ১২:১১ টায় (১৪ ও ১৫ মে মধ্যরাত্রি) হবে, যাকে বৃষ সংক্রান্তির সূচনা বলে মনে করা হয়। জ্যোতিষ অনুসারে, সূর্যের এই পরিবর্তন ধর্মীয় ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীয় দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই সময় থেকেই সংক্রান্তির পুণ্যকাল আরম্ভ হয়।

শুভ মুহূর্ত (পুণ্য কাল) এবং যোগ

বৃষ সংক্রান্তির দিন দান-পুণ্য এবং পূজা-পাঠের জন্য বিশেষ শুভ মুহূর্ত (পুণ্য কাল) থাকে। এই বার পুণ্য কাল সকাল ৫:৫৭ টা থেকে দুপুর ১২:১৮ টা পর্যন্ত থাকবে, যাতে ধর্মীয় কাজ করা শুভ বলে মনে করা হয়। এর সাথে সাথে মহাপুণ্য কাল সকাল ৫:৩০ টা থেকে ৭:৪৬ টা পর্যন্ত থাকবে, যা সংক্রান্তির সবচেয়ে পবিত্র সময়। এই সময়ের মধ্যে স্নান, সূর্যকে অর্ঘ্য দেওয়া এবং দান করা অত্যন্ত পুণ্যদায়ক। এছাড়াও, অভিজিৎ মুহূর্ত দুপুর ১১:৫০ টা থেকে ১২:৪৫ টা পর্যন্ত, যা কোনও শুভ কাজের সূচনার জন্য উত্তম সময় বলে মনে করা হয়।

এই দিনে অনেক শুভ যোগও হচ্ছে। সকাল ৭:০২ টা পর্যন্ত শিব যোগ থাকবে, যা সকল কাজে সাফল্য এনে দেয়। এর পর সিদ্ধ যোগ এবং ভদ্রা যোগের প্রভাব থাকবে, যা কোনও ধর্মীয় কাজ, পূজা, ব্রত এবং দানের জন্য অত্যন্ত লাভজনক বলে মনে করা হয়। এই যোগগুলির সংযোগে বৃষ সংক্রান্তির গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। এই সময় শ্রদ্ধা সহকারে করা পুণ্যকর্মের ফল অনেকগুণ বেশি পাওয়া যায়।

পূজা ও অনুষ্ঠানের বিশেষ মুহূর্ত

বৃষ সংক্রান্তিতে পূজা-পাঠ, মন্ত্রজপ এবং বিশেষ অনুষ্ঠানের অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। এই দিনে কিছু বিশেষ মুহূর্ত থাকে, যার মধ্যে ধর্মীয় ক্রিয়া করলে অধিক পুণ্যফল লাভ হয়। ব্রহ্মমুহূর্ত সকাল ৪:০৭ টা থেকে ৪:৪৯ টা পর্যন্ত থাকবে। এই সময় ধ্যান, যোগ এবং মন্ত্রজপের জন্য সবচেয়ে উত্তম বলে মনে করা হয়, কারণ এই সময় পরিবেশ শুদ্ধ ও শান্ত থাকে।

এছাড়াও, বিজয় মুহূর্ত দুপুর ২:৩৩ টা থেকে ৩:২৮ টা পর্যন্ত থাকবে, যা কোনও কাজে সাফল্য পাওয়ার জন্য শুভ। গোধূলি মুহূর্ত সন্ধ্যা ৭:০৪ টা থেকে ৭:২৫ টা পর্যন্ত সময় লক্ষ্মী পূজা এবং ঘরে সুখ-সমৃদ্ধির জন্য ভালো বলে মনে করা হয়। নিশীথ মুহূর্ত রাত ১১:৫৭ টা থেকে ১২:৩৮ টা পর্যন্ত, যা গোপন পূজা বা বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য শ্রেষ্ঠ। এই সকল মুহূর্তে শ্রদ্ধা সহকারে করা পূজা জীবনে ইতিবাচকতা ও আধ্যাত্মিক শক্তি আনে।

বৃষ সংক্রান্তিতে কী কী দান করবেন?

বৃষ সংক্রান্তির দিন হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত শুভ ও পুণ্যদায়ক বলে মনে করা হয়। সূর্য যখন বৃষ রাশিতে প্রবেশ করে তখন এই সংক্রান্তি হয়। এই দিনে দান-পুণ্যের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে কারণ বিশ্বাস করা হয় এই দিনে দেওয়া দান অনেকগুণ ফল দেয়। যদি আপনি সঠিক জিনিসগুলি সত্যিকারের মন এবং শ্রদ্ধা সহকারে দান করেন, তাহলে পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং জীবনে সুখ-শান্তি আসে। আসুন জেনে নেই, এই দিনে কোন কোন জিনিস দান করা উচিত।

তিল এবং গুড়: বৃষ সংক্রান্তিতে তিল এবং গুড়ের দান অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। তিল পবিত্রতা এবং পরিশুদ্ধতার প্রতীক, অন্যদিকে গুড় মিষ্টতা ও স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত। তিল-গুড় দানের ফলে পিতৃদোষ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং শরীরে ইতিবাচক শক্তি বজায় থাকে। এই দান বিশেষ করে বৃদ্ধ এবং গরিবদের দেওয়া উচিত।

দেশী ঘি এবং চিনি: দেশী ঘি এবং চিনির দানের ফলে ঘরে সুখ-শান্তি এবং ইতিবাচকতা বৃদ্ধি পায়। এই দান বিশেষ করে অগ্নিহোত্র ক্রিয়া এবং হোম ইত্যাদির সাথে জড়িত, যা পরিবেশকে পরিশুদ্ধ করার কাজ করে। এর ফলে মানসিক চাপ দূর হয় এবং পরিবারে প্রেম বজায় থাকে।

বস্ত্র (সাদা বা হলুদ রঙের): বৃষ সংক্রান্তিতে সাদা বা হলুদ রঙের কাপড় দান করা অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। সাদা রঙ শান্তি ও পরিশুদ্ধতার প্রতীক, অন্যদিকে হলুদ রঙ জ্ঞান ও শক্তির সাথে জড়িত। এই বস্ত্র দানের ফলে ব্যক্তি মান-সম্মান, সৌভাগ্য এবং উত্তম কাজের ফল পায়।

জলপূর্ণ কলসী (মাটি বা তামার): গরমের সময়ে ঠান্ডা পানি প্রাণদায়ক। এই দিনে মাটি বা তামার পাত্রে ঠান্ডা পানি ভরে দরিদ্র বা তৃষ্ণার্তদের দেওয়া অত্যন্ত পুণ্যদায়ক বলে মনে করা হয়। এই দান শুধুমাত্র গ্রহদোষ থেকে মুক্তি দেয় না, বরং সূর্যদেবের কৃপাও লাভ হয়।

ফল এবং মিষ্টান্ন: ফল এবং মিষ্টান্ন দান করলে অন্ন-ধনের বৃদ্ধি হয় এবং মন প্রসন্ন হয়। এই দান দরিদ্র শিশু, বৃদ্ধ এবং ব্রাহ্মণদের দেওয়া উত্তম। এর ফলে আপনার জীবনেও মিষ্টতা এবং সমৃদ্ধি আসে।

রুপো বা তামার পাত্র: যদি আপনি রুপো বা তামার পাত্র দান করেন তাহলে এটি সূর্য এবং চন্দ্র গ্রহের সাথে সম্পর্কিত সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এই দান আপনার কুণ্ডলীতে থাকা গ্রহদোষ শান্ত করে এবং জীবনে স্থায়িত্ব আনে।

জলপূর্ণ পাত্র দান করা: এটি একটি সহজ কিন্তু অত্যন্ত ফলপ্রসূ দান। জলপূর্ণ পাত্র কোন দরিদ্র বা প্রয়োজনীয় ব্যক্তিকে দান করলে জীবনে স্থায়িত্ব, শান্তি এবং ইতিবাচক শক্তি লাভ করা যায়। এছাড়াও এটি একটি মানবিক ও করুণাময় কাজ।

বৃষ সংক্রান্তি: আধ্যাত্মিক উন্নতির শুভ সুযোগ

বৃষ সংক্রান্তি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং আধ্যাত্মিক সচেতনতা এবং মানসিক শুদ্ধির বিশেষ সুযোগ। এই দিনে করা পূজা-পাঠ, ব্রত, জপ এবং দানের মাধ্যমে আমাদের মন এবং আত্মা উভয়ই শক্তিশালী হয়। এর ফলে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় না, বরং জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সাফল্যও লাভ হয়।

এই উৎসবটি আমাদের সঠিক পথে চলার অনুপ্রেরণা দেয় এবং আমাদের মধ্যে ইতিবাচক শক্তির সঞ্চার করে। তাই, বৃষ সংক্রান্তিতে যে ধর্মীয় কাজই আমরা করি না কেন, তা আমাদের জীবনকে উন্নত করতে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ সহজ করতে সাহায্য করে।

এই বৃষ সংক্রান্তিতে কী করবেন?

এই বৃষ সংক্রান্তিতে আপনি নিম্নলিখিত বিষয়গুলির প্রতি অবশ্যই ধ্যান দিন এবং এগুলিকে আপনার দৈনন্দিন কাজের সাথে যুক্ত করুন যাতে এই উৎসবটি আপনার জন্য সুখ-শান্তি এবং সমৃদ্ধি এনে দেয়:

  • সকালে তাড়াতাড়ি উঠে স্নান করুন এবং ভগবান সূর্যকে জল, তিল এবং গুড় দিয়ে অর্ঘ্য প্রদান করুন। এতে আপনার জীবনে শক্তি ও স্বাস্থ্যের সঞ্চার হবে।
  • শুভ মুহূর্তে মন্ত্রজপ, তপস্যা এবং হোম করুন। এতে আপনার পরিবারে দেবী-দেবতাদের কৃপা বজায় থাকে এবং সকল দুঃখ দূর হয়।
  • উপরে উল্লেখিত জিনিসপত্র যেমন তিল, গুড়, ঘি, বস্ত্র এবং জলপূর্ণ পাত্র দান করুন। দান করলে আপনার পুণ্য বৃদ্ধি পায় এবং জীবনে সমৃদ্ধি আসে।
  • ঘরে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরির জন্য হনুমান চালিসা, आदित्य हृदय स्तोत्र বা সূর্যাষ্টকের নিয়মিত পাঠ করুন। এতে মানসিক শান্তি ও সুরক্ষা পাওয়া যায়।

Leave a comment