ভারত সরকার ৬GHz স্পেকট্রামের জন্য ডিলাইসেন্সিং নিয়মের খসড়া প্রস্তুত করেছে, যা দেশে ওয়াই-ফাই ৬ (WiFi 6) ব্রডব্যান্ডের প্রসারের জন্য একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত হবে। এই খসড়া নিয়মের উপর সকল স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে ১৫ জুন, ২০২৫ তারিখের মধ্যে পরামর্শ চাওয়া হয়েছে, এরপর এটি কার্যকর করা হবে। এই নতুন নিয়ম কার্যকর হওয়ার সাথে সাথেই ভারতে দ্রুত, নির্ভরযোগ্য এবং আরও বেশি সংযোগক্ষম ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার সম্ভব হবে, যা বাড়ি, অফিস এবং জনসাধারণের স্থানে ডিজিটাল অভিজ্ঞতাকে উন্নত করবে।
৬GHz ব্যান্ডের চাহিদা এবং সরকারের সিদ্ধান্ত
টেক কোম্পানি এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (ISP) গুলি দীর্ঘদিন ধরে ৬GHz স্পেকট্রাম নিয়ে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। ওয়াই-ফাই ৬ প্রযুক্তির জন্য ৬GHz ব্যান্ড অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি বর্তমানে উপলব্ধ ২.৪GHz এবং ৫GHz ব্যান্ডের তুলনায় উন্নত গতি এবং উন্নত সংযোগ প্রদান করে। ৬GHz ব্যান্ড ব্যবহার করে গ্রাহকরা ২Gbps পর্যন্ত গতি পেতে পারেন, যা বর্তমান ৫GHz ব্যান্ডের ১Gbps গতির দ্বিগুণ।
সরকার ১৬ মে, ২০২৫ তারিখে টেলিযোগাযোগ আইন, ২০২৩-এর ধারা ৫৬-এর অধীনে এই নিয়মের খসড়া প্রকাশ করেছে, যেখানে ৫৯২৫ MHz থেকে ৬৪২৫ MHz পর্যন্ত ব্যান্ডকে ডিলাইসেন্সিং ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে রাখা হয়েছে। এর অর্থ হল এই ব্যান্ডে কম পাওয়ার এবং খুব কম পাওয়ারের ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস সিস্টেম লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবহার করা যাবে, যার ফলে ওয়াই-ফাই ৬ এর মতো আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে সুবিধা হবে।
ডিলাইসেন্সিংয়ের কি কি সুবিধা হবে?
ডিলাইসেন্সিং এর অর্থ হল ইন্টারনেট এবং টেক কোম্পানিগুলিকে এই স্পেকট্রাম ব্যান্ড ব্যবহার করার জন্য কোনও বিশেষ লাইসেন্স নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এর ফলে নতুন পণ্য এবং সেবা দ্রুত বাজারে আসবে, এবং কোম্পানিগুলিকে অতিরিক্ত ব্যয় থেকে মুক্তি পাবে। পাশাপাশি, ব্যবহারকারীরাও দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগ পেতে সহজতর হবে।
সরকার স্পষ্ট করেছে যে ৬GHz ব্যান্ডে লো পাওয়ারের ডিভাইসগুলি রেডিও লোকাল নেটওয়ার্কের জন্য ব্যবহার করা যাবে, যার মধ্যে ওয়াই-ফাই রাউটার, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, AR/VR ডিভাইস এবং অন্যান্য ওয়্যারলেস ডিভাইস অন্তর্ভুক্ত। এই নিয়মের অধীনে ৬GHz ব্যবহার তেল প্ল্যাটফর্ম, ল্যান্ড ভেহিকেল, নৌকা এবং বিমানচালনায় নিষিদ্ধ থাকবে, যার ফলে এটি নিশ্চিত হবে যে কোনও বাধা বা হস্তক্ষেপ হবে না।
প্রযুক্তিগত মানদণ্ড এবং নিরাপত্তা
ডেপার্টমেন্ট অফ টেলিকম (DoT) এই খসড়ায় নিরাপত্তা এবং অ-হস্তক্ষেপ (Non-Interference) এর শর্তগুলিও যুক্ত করেছে। এর উদ্দেশ্য ৬GHz ব্যান্ড ব্যবহার করে অন্যান্য যোগাযোগ সেবা এবং ডিভাইসগুলিকে কোনও ধরণের অসুবিধা না হয় তা নিশ্চিত করা। খসড়া অনুসারে, ইনডোর এবং আউটডোর উভয় জায়গাতেই লো পাওয়ার এবং খুব কম পাওয়ারের ডিভাইসগুলিকে এই ব্যান্ডে পরিচালনা করার অনুমতি দেওয়া হবে।
ড্রোন, মানববিহীন বিমান ব্যবস্থা এবং ১০,০০০ ফুটের নিচে উড়ান ভরার বিমানের জন্য এই ব্যান্ড ব্যবহার নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে যাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। এই পদক্ষেপ এই প্রযুক্তির নিরাপদ এবং নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে।
ইন্ডাস্ট্রি বডি BIF-এর ভূমিকা
ইন্ডাস্ট্রি বডি ব্রডব্যান্ড ইন্ডিয়া ফোরাম (BIF) দীর্ঘদিন ধরে এই স্পেকট্রাম ব্যান্ডের জন্য সরকারের কাছে নিয়ম তৈরির দাবি জানিয়ে আসছে। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে BIF টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে চিঠি লিখে এই বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। BIF-এর সদস্যরা মেটা, গুগল, আমাজন, মাইক্রোসফট, সিসকো, OneWeb, টাটা নালকো এবং হিউজস এর মতো বড় কোম্পানি, যারা এই স্পেকট্রামের উন্মুক্ত ব্যবহার করে তাদের সেবা প্রসার করতে চায়।
BIF বলেছিল যে নতুন প্রযুক্তি যেমন মেটা রে বান স্মার্ট গ্লাস, সনি PS5 এবং AR/VR হেডসেটগুলিকে উন্নত ডিজিটাল অভিজ্ঞতা প্রদানের জন্য ৬GHz ব্যান্ড জরুরি। পাশাপাশি এই ব্যান্ডে বিলম্বের ফলে প্রযুক্তি গ্রহণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
৬GHz ব্যান্ডের গুরুত্ব এবং প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য
৬GHz ব্যান্ড ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্কের জন্য নতুন এবং উন্নত স্পেকট্রাম, যা আগে ব্যবহৃত ২.৪GHz এবং ৫GHz ব্যান্ডের চেয়ে অনেক ভালো। এই ব্যান্ডে ইন্টারনেটের গতি অনেক দ্রুত হয়, যার ফলে উচ্চ-সংজ্ঞা ভিডিও স্ট্রিমিং, অনলাইন গেমিং এবং ভিডিও কলিং এর মতো সেবা কোনও বাধা ছাড়াই চলে। ৬GHz ব্যান্ডের কভারেজ এলাকাও বেশি হয়, তাই ইন্টারনেট সংযোগ দীর্ঘ সময় ধরে শক্তিশালী এবং স্থির থাকে। এর ফলে ব্যবহারকারীরা আরও ভাল অভিজ্ঞতা পান, বিশেষ করে যখন অনেক ডিভাইস একসাথে সংযুক্ত থাকে।
ওয়াই-ফাই ৬ প্রযুক্তির সাথে ৬GHz ব্যান্ড বেশি পরিমাণে ডেটা দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্যভাবে স্থানান্তর করতে পারে। এর অর্থ হল বাড়ি বা অফিসে অনেক স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, টিভি এবং অন্যান্য ডিভাইস একসাথে ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও সংযোগের মান প্রভাবিত হয় না। এই প্রযুক্তি নেটওয়ার্কের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সংযোগের সময় আসা সমস্যা যেমন নেটওয়ার্ক ধীর হওয়া বা সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া কমিয়ে দেয়। তাই ৬GHz ব্যান্ড আগামী সময়ে ইন্টারনেটের জগতে বিপ্লব সাধন করবে।
ডিজিটাল ইন্ডিয়া-র জন্য বড় পদক্ষেপ
ভারত সরকারের ৬GHz ব্যান্ড খোলার সিদ্ধান্ত ডিজিটাল ইন্ডিয়া মিশনের জন্য একটি বড় পদক্ষেপ। এর ফলে দেশে দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যাবে, যা বাড়ি এবং অফিসে কাজ করা আরও সহজ করে তুলবে। বিশেষ করে অনলাইন শিক্ষা, টেলিমেডিসিন অর্থাৎ দূর থেকে চিকিৎসা, স্মার্ট শহর নির্মাণ এবং ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) এর মতো নতুন নতুন প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রেও এতে ত্বরণ আসবে। উন্নত ইন্টারনেট থাকার ফলে মানুষ নতুন প্রযুক্তির সুবিধা পাবে এবং তাদের জীবন সহজ হবে।
৬GHz ব্যান্ড খোলার ফলে ভারতের টেক কোম্পানিগুলি নতুন নতুন পণ্য এবং সেবা উন্নত করতে পারবে। এর ফলে তারা বিশ্বের বাজারে তাদের দখল মজবুত করতে পারবে এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে ভাল প্রতিযোগিতা করতে পারবে। পাশাপাশি, এর ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং দেশের ডিজিটাল অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র প্রযুক্তির জন্য নয়, সমগ্র দেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৬GHz ব্যান্ডের জন্য সরকার কর্তৃক খসড়া করা ডিলাইসেন্সিং নিয়ম ভারতের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং টেক ইন্ডাস্ট্রি উভয়ের জন্যই বড় সুবিধা নিয়ে আসবে। এর ফলে ভারতে ওয়াই-ফাই ৬ ব্যবহার সহজ হবে, যা দ্রুত ইন্টারনেট গতি, উন্নত নেটওয়ার্ক কভারেজ এবং নির্ভরযোগ্য সংযোগ নিশ্চিত করবে। এই পদক্ষেপ ভারতকে বৈশ্বিক ডিজিটাল বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করবে এবং দেশের ডিজিটাল উন্নয়নকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ পাওয়ার পর এই নিয়মের চূড়ান্ত আকার দিয়ে দ্রুত কার্যকর করা হবে, যার ফলে ভারতের ডিজিটাল বিপ্লবে একটি নতুন গতি আসবে।