SpaceX-এর ঐতিহাসিক উৎক্ষেপণ: ডাইরেক্ট-টু-সেল প্রযুক্তিসমৃদ্ধ Starlink উপগ্রহ

SpaceX-এর ঐতিহাসিক উৎক্ষেপণ: ডাইরেক্ট-টু-সেল প্রযুক্তিসমৃদ্ধ Starlink উপগ্রহ
সর্বশেষ আপডেট: 23-05-2025

অন্তরীক্ষ প্রযুক্তির জগতে আরও একটি বড় ধাপ এগিয়ে, SpaceX ২০ মে ২০২৫-এ একটি সম্পূর্ণ নতুন ফ্যালকন ৯ রকেট বুস্টারের সাহায্যে ২৩টি স্টারলিঙ্ক V2 মিনি উপগ্রহকে সফলভাবে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে (Low Earth Orbit - LEO) স্থাপন করেছে। এই উৎক্ষেপণের বিশেষ দিক হল এর মধ্যে ১৩টি উপগ্রহ আধুনিক ডাইরেক্ট-টু-সেল (Direct-to-Cell) প্রযুক্তি দ্বারা সজ্জিত, যা সরাসরি মোবাইল ফোন থেকে উপগ্রহ সংযোগের সুবিধা প্রদান করবে।

একটি ঐতিহাসিক উড়ান

২০ মে রাতে আমেরিকার ফ্লোরিডা রাজ্যের কেপ ক্যানাভেরাল স্পেস ফোর্স স্টেশন থেকে SpaceX একটি নতুন ইতিহাস রচনা করে। কোম্পানি তাদের সম্পূর্ণ নতুন ফ্যালকন ৯ রকেট দিয়ে ২৩টি স্টারলিঙ্ক উপগ্রহকে সফলভাবে মহাকাশে পাঠিয়েছে। এই মিশন বিশেষ ছিল কারণ এটি ২০২৫ সালে SpaceX-এর ৬০তম উৎক্ষেপণ ছিল, যা দেখায় কোম্পানি কত দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্যতার সাথে মিশন সম্পন্ন করছে। এত কম খরচে ক্রমাগত সফল উৎক্ষেপণ SpaceX কে অন্যান্য কোম্পানি থেকে আলাদা করে।

এই মিশনে যে রকেট ব্যবহার করা হয়েছিল, তা প্রথমবারের মতো উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। সাধারণত SpaceX তাদের পুরানো রকেট বুস্টার বারবার ব্যবহার করে, যার ফলে খরচও কম হয়। কিন্তু এবার কোম্পানি একটি নতুন বুস্টার (B1095) ব্যবহার করেছে, যা এই মিশনকে আরও বিশেষ করে তুলেছে। এটি দেখায় যে কোম্পানি কেবলমাত্র পুনঃব্যবহারের উপর নজর দেয় না, বরং নতুন প্রযুক্তিগত সরঞ্জামগুলিও সময় সময় পরীক্ষা করে।

ডাইরেক্ট-টু-সেল প্রযুক্তির শক্তি

এই মিশনে উৎক্ষেপণ করা ২৩টি উপগ্রহের মধ্যে ১৩টিতে ডাইরেক্ট-টু-সেল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত বিশেষ এবং উপযোগী প্রযুক্তি, যা সেইসব এলাকায় কাজে লাগে যেখানে মোবাইল টাওয়ার বা নেটওয়ার্কের সুবিধা নেই। এর সাহায্যে সাধারণ মোবাইল ফোনে কোনও আলাদা ডিভাইস বা স্যাটেলাইট ফোন ছাড়াই নেটওয়ার্ক সংযোগ পাওয়া যাবে। অর্থাৎ এখন আপনি সমুদ্রে থাকুন, জঙ্গলে থাকুন বা কোনও পাহাড়ি এলাকায়, নেটওয়ার্ক পাওয়া আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে যাবে।

ডাইরেক্ট-টু-সেল প্রযুক্তি দূরবর্তী এবং অপ্রাপ্ত এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এতে কেবল সাধারণ মানুষই উপকৃত হবে না, বরং এই প্রযুক্তি জরুরি সেবা, সেনাবাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ত্রাণ-উদ্ধার কাজেও সহায়ক হতে পারে। নেটওয়ার্কের এই নতুন সুবিধা আগামী সময়ে বিশ্বের প্রতিটি কোণে যোগাযোগ স্থাপনের দিকে একটি বড় ধাপ বলে মনে করা হচ্ছে।

উৎক্ষেপণের নির্ণায়ক পদক্ষেপ

এই মিশনের উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া কিছুটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রথমে এটি ১৯ মে রাত ১১:৫৮ (EDT) উৎক্ষেপণ করা হবে বলে পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোনও প্রযুক্তিগত বা আবহাওয়াগত কারণে তা পিছিয়ে দেওয়া হয়। যদিও কোম্পানি তার পিছনেকার কারণ স্পষ্ট করে বলেনি, তবে ভালো দিক হল পরের রাতেই অর্থাৎ ২০ মে রাত ১১:১৯ (২১ মে ভোর ৩:১৯ GMT) এই মিশন সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়। রকেট উড়ে যাওয়ার প্রায় আড়াই মিনিট পরে তার প্রথম অংশ অর্থাৎ বুস্টার মূল রকেট থেকে আলাদা হয়ে যায়। এর পর রকেটের উপরের অংশ প্রায় ৬৫ মিনিট মহাকাশে ভ্রমণ করে এবং তারপর একটি ছোট ইঞ্জিন জ্বালিয়ে কক্ষপথকে গোলাকার করে। এরপর সমস্ত ২৩টি স্টারলিঙ্ক উপগ্রহকে ধীরে ধীরে তাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথে সফলভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত নির্ভুল এবং পরিকল্পিত, যার ফলে মিশনকে সম্পূর্ণ সফল বলে মনে করা হয়েছে।

পুনঃব্যবহারের দিকে আরও একটি পদক্ষেপ

উৎক্ষেপণের প্রায় আট মিনিট পরে, ফ্যালকন ৯ বুস্টার অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত SpaceX-এর ড্রোন জাহাজ "জাস্ট রিড দ্য ইনস্ট্রাকশন্স"-এ সফলভাবে অবতরণ করে। এই অবতরণ ছিল অত্যন্ত নির্ভুল এবং নিরাপদ, যা SpaceX-এর পুনঃব্যবহারের কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই কৌশল অনুসারে কোম্পানি বুস্টার রকেট ফিরিয়ে আনার পর তা বারবার ব্যবহার করে। এতে কেবল খরচে বিশাল সাশ্রয় হয় না, বরং মিশনের ফ্রিকোয়েন্সিও বৃদ্ধি পায়। এই কারণে মহাকাশ মিশন আরও সাশ্রয়ী এবং নিয়মিতভাবে করা সম্ভব হচ্ছে, যা মহাকাশ প্রযুক্তির জগতে একটি বড় বিপ্লব হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে।

স্টারলিঙ্কের মেগাকনস্টেলেশন পরিকল্পনা

SpaceX-এর স্টারলিঙ্ক পরিকল্পনা বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ স্যাটেলাইট ইন্টারনেট প্রকল্প। বর্তমানে প্রায় ৭,৫০০ স্টারলিঙ্ক উপগ্রহ পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে কাজ করছে এবং এই সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই উপগ্রহগুলির প্রধান উদ্দেশ্য হল সেসব এলাকায় দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানো, যেখানে ঐতিহ্যগত নেটওয়ার্কের পৌঁছনো নেই।

এইবার উৎক্ষেপণ করা V2 মিনি উপগ্রহগুলি আগের চেয়ে আরও উন্নত। এগুলিতে উন্নত কভারেজ, বেশি ডেটা পরিচালনার ক্ষমতা এবং শক্তিশালী প্রযুক্তিগত স্থায়িত্ব রয়েছে। এই উপগ্রহগুলি বিশেষ করে সেইসব দূরবর্তী এলাকায় ইন্টারনেট সেবা উন্নত করতে সাহায্য করবে, যেখানে আজও ইন্টারনেটের পৌঁছনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিদ্যমান। এর ফলে সমগ্র বিশ্বে ইন্টারনেট সংযোগের মান উন্নত হবে।

এই উৎক্ষেপণের পরে কী পরিবর্তন হবে?

গ্রামীণ এবং দূরবর্তী এলাকায় উন্নত নেটওয়ার্ক : এই উৎক্ষেপণের পরে বিশেষ করে গ্রামীণ এবং দূরবর্তী এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কের পৌঁছনো বৃদ্ধি পাবে। ভারতের মতো বৃহৎ দেশে, যেখানে এখনও অনেক গ্রাম এবং ছোট শহরে নেটওয়ার্কের অভাব রয়েছে, ডাইরেক্ট-টু-সেল স্যাটেলাইট সেখানে নেটওয়ার্কের বড় সমস্যা দূর করতে পারে। এর ফলে মানুষ ইন্টারনেট এবং কলিংয়ের মতো সেবা সহজে পেতে পারবে।

জরুরি অবস্থায় দ্রুত সংযোগ : ভূমিকম্প, বন্যা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যখন ভূমিতে তৈরি টাওয়ার বা নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়, তখন এই স্যাটেলাইটগুলি দ্রুত সংযোগ সরবরাহ করতে পারবে। এর ফলে উদ্ধার কার্যক্রম দ্রুত এবং কার্যকর হবে, কারণ জরুরি সেবা দল এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে।

আন্তর্জাতিক এবং সমুদ্রী সংযোগে উন্নতি : এই প্রযুক্তির সাহায্যে ব্যবহারকারীরা এখন অতিরিক্ত রোমিং চার্জ ছাড়াই সমুদ্রী এলাকায় বা বিদেশেও তাদের মোবাইল ফোন থেকে স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত থাকতে পারবে। এটি বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কের পৌঁছনো বৃদ্ধি করবে এবং বিশেষ করে যারা ঘন ঘন সমুদ্রী বা আন্তর্জাতিক ভ্রমণ করে তাদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে।

SpaceX-এর এই উৎক্ষেপণ প্রযুক্তিগত এবং বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটি নতুন বুস্টার, ডাইরেক্ট-টু-সেল স্যাটেলাইট এবং সফল উদ্ধার - তিনটিই এই মিশনকে ঐতিহাসিক করে তুলেছে। ভবিষ্যতে SpaceX-এর এই প্রযুক্তি কেবল ইন্টারনেটের সীমা ভাঙবে না, বরং মোবাইল নেটওয়ার্কিং এর একটি নতুন অধ্যায়ও লিখবে। ডাইরেক্ট-টু-সেল ফিচার সহ, এখন মহাকাশ থেকে সরাসরি মোবাইলে কথা বলা কেবল কল্পনা নয়, বাস্তবে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

Leave a comment