মণিপুরে নতুন সরকার গঠনের দাবি: বিজেপির ৪৪ বিধায়কের সমর্থন

মণিপুরে নতুন সরকার গঠনের দাবি: বিজেপির ৪৪ বিধায়কের সমর্থন
সর্বশেষ আপডেট: 29-05-2025

মণিপুরে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন মিত্রজোট ৪৪ জন বিধায়কের সমর্থনে নতুন সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছে। এন বিরেন সিংহের স্থলে নতুন মুখ্যমন্ত্রীর আলোচনা শুরু হয়েছে।

Manipur: মণিপুরের রাজনীতি আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। দীর্ঘদিন ধরে চলা জাতিগত হিংসার পর রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। সম্প্রতি বিজেপি (BJP)-নেতৃত্বাধীন এনডিএ (NDA) মিত্রজোটের ১০ জন বিধায়কের একটি প্রতিনিধিদল রাজ্যপাল অজয় কুমার ভাল্লা-র সাথে সাক্ষাৎ করে ৪৪ জন বিধায়কের সমর্থনের দাবি জানিয়ে নতুন সরকার গঠনের প্রস্তুতি ব্যক্ত করেছে। এই ঘটনাপ্রবাহ মণিপুরের রাজনীতিতে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আসলে এই হঠাৎ সরকার গঠনের পেছনে কী কাহিনী? এন বিরেন সিংহ কি আবার মুখ্যমন্ত্রী হবেন নাকি কোনও নতুন মুখ দেখা দেবে? আসুন, এই সম্পূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ বিস্তারিতভাবে জেনে নেই।

মণিপুরে দুই বছর ধরে চলা অস্থিরতা এবং জাতিগত হিংসা

মণিপুর গত দুই বছর ধরে জাতিগত হিংসার আগুনে পুড়ছে। মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে চলে আসা উত্তেজনার ফলে রাজ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হয়ে পড়েছে। এদিকে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মুখ্যমন্ত্রী এন বিরেন সিংহ ইস্তফা দিয়েছিলেন, যার পর মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন (President's Rule) জারি করা হয়। এখন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার আবারও সরকার গঠনের দিকে অগ্রসর হয়েছে।

৪৪ জন বিধায়কের সমর্থন, বিজেপির দাবি

বিজেপি বিধায়ক থোকচোম রাধেশ্যাম সিংহের নেতৃত্বে এনডিএ-র ১০ জন বিধায়কের প্রতিনিধিদল রাজ্যপালের সাথে সাক্ষাৎ করে। তারা দাবি করেছে যে তাদের ৪৪ জন বিধায়কের সমর্থন রয়েছে এবং তারা নতুন সরকার গঠনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। বিজেপির মতে, বিধানসভা অধ্যক্ষও ৪৪ জন বিধায়কের সাথে ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীগতভাবে সাক্ষাৎ করেছেন এবং কেউই সরকার গঠনের বিরোধিতা করেননি।

এর অর্থ স্পষ্ট যে বিজেপির কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। মণিপুর বিধানসভার মোট ৬০ টি আসনের মধ্যে একটি আসন বর্তমানে শূন্য, তাই মোট ৫৯ টি আসনের মধ্যে ৪৪ জন বিধায়কের সমর্থন একটি শক্তিশালী অবস্থান প্রমাণ করে।

হঠাৎ সরকার গঠনের উদ্যোগ কেন?

প্রশ্ন উঠেছে যে, আসলে হঠাৎ করে এই সরকার গঠনের উদ্যোগ কেন শুরু হলো? মণিপুরে চলমান রাষ্ট্রপতি শাসনের মধ্যে এই পদক্ষেপ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক ইঙ্গিত বহন করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই উদ্যোগ মণিপুরের "সেন্টিমেন্ট টেস্ট" করার জন্য। অর্থাৎ, বিজেপি দেখতে চায় জনগণ এবং অন্যান্য শ্রেণীর মনোভাব কী।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক জোসেফ লেপচার মতে, মণিপুরে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আগের তুলনায় উন্নত হচ্ছে। বিজেপি সম্ভবত এই পরিবেশকে বুঝে সরকার গঠনের পদক্ষেপ কতটা উপকারী হবে তা দেখতে চাইছে। বিজেপির চেষ্টা হতে পারে তাদের আধিপত্যকে আরও শক্তিশালী করার, বিশেষ করে যখন ২০২৭ সালে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

বিরেন সিংহ ফিরে আসবেন নাকি নতুন মুখ আসবে?

একটি বড় প্রশ্ন হল, যদি মণিপুরে আবার সরকার গঠিত হয়, তাহলে কি এন বিরেন সিংহ আবার মুখ্যমন্ত্রী হবেন নাকি কোনও নতুন মুখ দেখা দেবে?

রাজনৈতিক সমীকরণ পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় যে, বিরেন সিংহের আবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া বর্তমানে নিশ্চিত নয়। থোকচোম রাধেশ্যাম সিংহ, যিনি নিজেও মেইতেই সম্প্রদায়ের, প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এটি ইঙ্গিত দিতে পারে যে বিজেপি এবার বিরেন সিংহের পরিবর্তে অন্য কোনও নেতাকে সুযোগ দিতে পারে।

মণিপুরের রাজনীতিতে মেইতেই সম্প্রদায়ের আধিপত্য রয়েছে। বিজেপির ৪৪ জন বিধায়কের মধ্যে ৩২ জন মেইতেই বিধায়ক, ৩ জন মণিপুরী মুসলমান, ৯ জন নাগা বিধায়ক এবং কিছু কুকি বিধায়ক ছিলেন। তবে, হিংসার পর সাতজন কুকি বিধায়ক বিজেপি মিত্রজোট থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। এমতাবস্থায় মেইতেই ভোটারদের ক্ষুব্ধ করা বিজেপির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তাই এমন কোনও নেতাকে এগিয়ে আনা সম্ভব যিনি মেইতেই সম্প্রদায়ের, কিন্তু যাদের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথেও ভালো সম্পর্ক রয়েছে।

বিরেন সিংহের বিরোধিতার কারণ কী?

দীর্ঘদিন ধরে বিরেন সিংহের ইস্তফার দাবী উঠে আসছে। কুকি সংগঠনগুলি সরকারের উপর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অভিযোগ করেছে, যার ফলে রাজ্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তবে, বিরেন সিংহ মেইতেই ভোটারদের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রীর পদে টিকে ছিলেন। কিন্তু এখন বিজেপির কৌশল বদলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। পার্টি সম্ভবত এবার নতুন মুখ এনে এই বার্তা দিতে চাইছে যে তারা সকলকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছে।

মণিপুর বিধানসভার শক্তি: মেইতেইদের আধিপত্য

মণিপুর বিধানসভার বর্তমান চিত্র দেখলে দেখা যায়, মোট ৫৯ জন বিধায়কের মধ্যে ৩৭ জন বিধায়ক মেইতেই সম্প্রদায়ের। বিজেপি মিত্রজোটের ৪৪ জন বিধায়কের মধ্যে ৩২ জন মেইতেই, ৩ জন মণিপুরী মুসলিম এবং ৯ জন নাগা বিধায়ক রয়েছে। কংগ্রেসের সকল ৫ জন বিধায়কও মেইতেই সম্প্রদায়ের। এমতাবস্থায় মেইতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা যে কোনও সরকারের মেরুদণ্ড।

কুকি বিধায়কদের সংখ্যা খুব কম এবং তারা ইতোমধ্যেই বিজেপি মিত্রজোট থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় বিজেপির প্রাথমিক লক্ষ্য মেইতেই সম্প্রদায়কে ধরে রাখা। তাই এটা সম্ভব যে দল মেইতেই সম্প্রদায়ের অন্য কোনও নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন করবে, যিনি বিরেন সিংহের স্থলাভিষিক্ত হতে পারবেন এবং বিরোধিতাকেও কমিয়ে আনতে পারবেন।

মণিপুরে বিজেপির পরবর্তী কৌশল কী হতে পারে?

বিজেপির জন্য মণিপুরে সরকার গঠন শুধুমাত্র ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রশ্ন নয়, বরং এটি একটি বড় রাজনৈতিক দাবা। ২০২৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলের জন্য প্রয়োজন রাজ্যে স্থিরতা দেখানো এবং এই বার্তা দেওয়া যে বিজেপির নেতৃত্বে মণিপুর নিরাপদ এবং স্থিতিশীল।

সরকার গঠনের এই পদক্ষেপকে বিজেপি একটি ইতিবাচক বার্তা হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে যে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে এবং রাজ্যকে একটি স্থিতিশীল নেতৃত্বের প্রয়োজন। তবে, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ হবে, কারণ মুখ্যমন্ত্রীর মুখ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত দিল্লিতেই নেওয়া হবে।

Leave a comment