বিজেপির জাতিগত জনগণনা পরিকল্পনা: ওবিসি-দলিত ভোট ফিরে পাওয়ার রণকৌশল

বিজেপির জাতিগত জনগণনা পরিকল্পনা: ওবিসি-দলিত ভোট ফিরে পাওয়ার রণকৌশল
সর্বশেষ আপডেট: 04-05-2025

ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জাতিগত জনগণনার বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বের সাথে কাজ করছে এবং এটিকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। দলের প্রধান উদ্দেশ্য হল ওবিসি এবং দলিত শ্রেণীর ভোট আবার আকর্ষণ করা, যাদের সাথে গত কয়েক বছরে দূরত্ব বেড়েছে।

জাতিগত জনগণনা বিজেপির পরিকল্পনা: কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার জাতিগত জনগণনা নিয়ে একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নতুন মোড় আনার প্রস্তুতি নিয়েছে। পূর্বে যে বিষয়টিকে কেবলমাত্র বিরোধী দল যেমন কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি এবং আরজেডি-এর এজেন্ডা বলে মনে করা হতো, এখন সেই বিষয়টি বিজেপির রাজনৈতিক কেন্দ্রে চলে এসেছে।

এটি কেবলমাত্র একটি নীতিগত পদক্ষেপ নয়, বরং একটি পরিকল্পিত সামাজিক ও রাজনৈতিক কৌশলের অংশ, যাকে ‘মণ্ডল ২.০’ নাম দেওয়া হচ্ছে। এই নতুন কৌশলের অধীনে, বিজেপি তার ঐতিহ্যগত হিন্দুত্বের এজেন্ডা ‘কমণ্ডল’ কে পিছিয়ে পড়া জাতিগুলির প্রতিনিধিত্বের সাথে যুক্ত করে একটি ব্যাপক সামাজিক জোট গঠন করতে চায়।

রাজনৈতিক সমীকরণ পরিবর্তনের প্রস্তুতি

২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত, বিজেপি দেশজুড়ে সামাজিক শ্রেণীর এমন একটি জোট তৈরি করেছিল, যার মধ্যে উচ্চবর্ণের পাশাপাশি অ-প্রধান ওবিসি এবং এসসি/এসটি শ্রেণীও অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ওবিসি পটভূমি এবং জন-কল্যাণমূলক পরিকল্পনার মাধ্যমে দলটি গ্রামীণ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।

কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং হরিয়ানা রাজ্যে বিজেপি ওবিসি এবং দলিত ভোটের ক্ষেত্রে ধাক্কা খেয়েছিল, এবং এই ভোটের একটি অংশ ইন্ডিয়া জোটের দিকে চলে গেছে।

এখন বিজেপি এই ভোটব্যাংকটিকে ফিরিয়ে আনার জন্য জাতিগত জনগণনার সাহায্যে আবার নিজের ভিত্তি মজবুত করতে চায়। দলের পরিকল্পনা স্পষ্ট—ওবিসি এবং দলিত সম্প্রদায়কে এই আশ্বাস দেওয়া যে বিজেপি কেবলমাত্র ‘সবকের সাথে, সবকের উন্নয়ন’ কথাই বলে না, বরং তার জন্য বাস্তব পদক্ষেপও নেয়।

ওবিসি নেতৃত্ব এবং মোদীর ভাবমূর্তিকে শক্তিশালীকরণ

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বিজেপি ক্রমাগত এমন একজন নেতা হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে যিনি কেবলমাত্র ওবিসি শ্রেণী থেকে এসেছেন, তিনিই নন, গরিবদের উন্নয়নের জন্য অনেক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জাতিগত জনগণনার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দলটি মোদীর এই ভাবমূর্তিকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি, বিজেপি এটাও নিশ্চিত করতে চায় যে তার ওবিসি নেতারা, যেমন উত্তরপ্রদেশের ডেপুটি সিএম কেশব প্রসাদ মৌর্য এবং বিহারে নীতিশ কুমারের মতো সহযোগী দলের সাথে দৃঢ়ভাবে জড়িত থাকবেন।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বাধীন উদ্যোগগুলিতে নিয়ন্ত্রণের কৌশল

জাতিগত তথ্য নিয়ে এখন পর্যন্ত অনেক রাজ্য নিজ নিজ পর্যায়ে জরিপ করেছে। বিহারে নীতিশ সরকার ২০২৩ সালে জাতিগত জরিপ করেছে এবং সংরক্ষণ নীতিতে পরিবর্তনের কথাও বলেছে। কর্ণাটক এবং তেলেঙ্গানায়ও কংগ্রেস সরকার এই বিষয়টিকে আক্রমণাত্মকভাবে তুলে ধরছে। কেন্দ্র সরকার এখন এই উদ্যোগটিকে নিজের হাতে নিয়ে রাজ্যগুলির স্বাধীন উদ্যোগগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এর পেছনে উদ্দেশ্য হল সংরক্ষণ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কিত নীতিগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে, একই রকম এবং তথ্যভিত্তিক হবে।

সামাজিক প্রকৌশলের নতুন অধ্যায়

বিজেপি ২০২৪ সালের পর থেকে তার সামাজিক সমীকরণে অনেক পরিবর্তন এনেছে। একদিকে জনধন যোজনা, উজ্জ্বলা যোজনা এবং প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা মতো পরিকল্পনা ছিল, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল। অন্যদিকে, বিজেপি উচ্চবর্ণকে সন্তুষ্ট করার জন্য ১০% ইডব্লিউএস কোটাও চালু করেছে। কিন্তু এখন দলটির ফোকাস ‘অ-প্রধান’ জাতিগুলিতে বেশি, যেমন নিষাদ, কুর্মি, কুশওয়া, লোহার, তেলি, কাশ্যপ ইত্যাদি যাদের প্রভাব আঞ্চলিক রাজনীতিতে নির্ণায়ক।

জাতিগত জনগণনার আড়ালে ব্যাপক জনসংযোগ অভিযান

জাতিগত জনগণনা কেবলমাত্র তথ্য সংগ্রহ নয়, বিজেপি এটিকে একটি ব্যাপক জনসংযোগ অভিযান হিসেবেও দেখছে। গ্রামে গ্রামে, গলিতে গলিতে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে বিজেপি প্রতিটি শ্রেণীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিশ্বাস করে, দলের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়াতে পারে। বিশেষ করে ইউপি, বিহার, ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যে যেখানে সামাজিক পরিচয়ই রাজনীতির অক্ষ, সেখানে এই সিদ্ধান্ত গেমচেঞ্জার হতে পারে।

‘কমণ্ডল’ এবং ‘মণ্ডল’ এর নতুন মিলন

বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে ‘কমণ্ডল’ অর্থাৎ রাম মন্দির, হিন্দুত্ব এবং সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে নির্বাচনে লাভ করে আসছে। কিন্তু এখন দলটি ‘মণ্ডল ২.০’ অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচার এবং জাতিগত প্রতিনিধিত্বের সাথে এই এজেন্ডাটি যুক্ত করছে। এই মিলন রাজনীতিতে নতুন এক যুগের সূচনা করতে পারে, যেখানে দলটি ধর্মীয় এবং সামাজিক উভয় পক্ষকেই সামঞ্জস্যপূর্ণ করে নিজের সমর্থন ভিত্তিকে আরও ব্যাপক করে তুলতে পারে।

Leave a comment