আমেরিকার জাতীয় ঋণ ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এলন মাস্ক এটাকে “আর্থিক সুনামি” বলে অভিহিত করেছেন এবং ট্রাম্পের ট্যাক্স বিলকে ঋণের দাসত্ব বলেছেন। বর্ধমান ঋণ মুদ্রাস্ফীতি এবং আর্থিক মন্দার আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।
আমেরিকা: আমেরিকার জাতীয় ঋণ আজ ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা দেশের জিডিপির ১২২ শতাংশ। এটি কেবলমাত্র আমেরিকান অর্থনীতির জন্যই নয়, সমগ্র বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থার জন্যও একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। এই ঋণের প্রেক্ষাপটেই বিশ্বের বিখ্যাত শিল্পপতি এবং টেসলার সিইও এলন মাস্ক গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি এই ঋণ বৃদ্ধিকে ‘আর্থিক সুনামি’ বলে অভিহিত করেছেন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্প্রতি প্রস্তাবিত ট্যাক্স বিলকে “Debt Slavery Bill” অর্থাৎ ঋণের দাসত্বের বিল বলেছেন। তাঁর মতে, এই বিল আমেরিকার ঋণ আরও বাড়াবে, ফলে দেশ আর্থিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি এবং নগদ সংকটের মতো গুরুতর সমস্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আমেরিকার ঋণ কতটা গুরুতর?
আমেরিকার ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণ সাধারণ নাগরিকের কাছে বোঝা সহজ নয়। এটিকে স্পষ্ট করার জন্য জানা প্রয়োজন যে ভারতের মোট অর্থনীতি বর্তমানে প্রায় ৪.১৯ ট্রিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, আমেরিকার উপর যে ঋণ রয়েছে, তা ভারতের অর্থনীতির প্রায় আট গুণ। এই ঋণ কেবলমাত্র ফেডারেল সরকারের বার্ষিক ব্যয় পূরণের জন্য নেওয়া ঋণ নয়, বরং এর মধ্যে সুদের পরিমাণও অন্তর্ভুক্ত।
জাতীয় ঋণ সেই পরিমাণকে বোঝায় যা আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন আর্থিক মাধ্যম যেমন ট্রেজারি বন্ড, নোট ইত্যাদি বিক্রি করে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেছে। যখন সরকারের আয় ব্যয়ের চেয়ে কম হয়, তখন তাকে এ ধরণের ঋণ নিতে হয়। এটি এমন একটি জাল যাতে না ফাঁসিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
এলন মাস্কের ঋণ নিয়ে গুরুতর সতর্কতা
এলন মাস্ক সম্প্রতি ট্রাম্পের ট্যাক্স বিলের সমালোচনা করে বলেছেন যে এই বিল আমেরিকাকে ঋণের জালে আরও গভীরে ঠেলে দিতে পারে। মাস্ক এই বিলকে "Debt Slavery Bill" বলেছেন, যার অর্থ এটি আমেরিকাকে অর্থনৈতিক দাসত্বের দিকে নিয়ে যাবে। তিনি জানিয়েছেন যে এই বিলের কারণে জাতীয় ঋণে ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি হতে পারে।
মাস্ক তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন যে, যদি এই বিল পাস হয়, তবে সরকারের মোট আয়ের বড় অংশ কেবলমাত্র ঋণের সুদে চলে যাবে, যার ফলে স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয়ের জন্য অর্থের অভাব দেখা দিবে। তিনি আমেরিকান জনতাকে ব্যয় কমাতে এবং সরকারকে তার সম্পদের অনুযায়ী কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
আমেরিকার ঋণ সংকটের বিশ্বব্যাপী প্রভাব
আমেরিকার এই অর্থনৈতিক অবস্থা কেবলমাত্র দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বব্যাপী এর গুরুতর পরিণতি দেখা দিতে পারে। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিও এর প্রভাব অনুভব করবে। রপ্তানি খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যদিও অন্য কিছু ক্ষেত্রে সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে।
ট্রাম্পের ট্যারিফ নীতি মুদ্রাস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। আমদানি করা পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ আরও বেড়ে যায়, যা সাধারণ নাগরিকের পকেটে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। মাস্ক বলছেন যে, যদি আমেরিকা ঋণ এবং বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ না করে, তবে এর ফলে আর্থিক মন্দার আশঙ্কা আরও বাড়বে।
ঋণ সংকটের গভীরতা এবং ভবিষ্যতের উদ্বেগ
আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে ২০৩৫ সালের মধ্যে আমেরিকার ঋণ জিডিপির ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এর অর্থ হল ঋণের বোঝা দেশের উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যাবে।
আমেরিকাকে প্রতি বছর তার ঋণের উপর সুদ পরিশোধ করতে হয়, যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেবলমাত্র ২০২৩ সালে আমেরিকা ঋণের সুদ পরিশোধে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে। যদি সুদের হার বৃদ্ধি পায়, তবে এই বোঝা আরও বেশি ভারী হবে, যার ফলে সরকারের সামাজিক ও প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয়ে প্রতিকূল প্রভাব পড়বে।
বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও আমেরিকান বন্ড বিক্রি করছে, যার ফলে বন্ড বাজারে অস্থিরতা বেড়েছে এবং নগদ সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মাস্ক সতর্ক করে বলেছেন যে এই আর্থিক অবস্থার কারণে আমেরিকা ডিফল্টের অবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে পারে, অর্থাৎ ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হতে পারে।
আর্থিক জায়ান্টদেরও সতর্কতা
আমেরিকার আর্থিক বাজারের প্রধান খেলোয়াড়রাও এই অবস্থাকে গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে। জেপি মর্গানের সিইও জেমি ডিমন বলেছেন যে দেশকে ব্যয়ের উপর অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। হেজ ফান্ড ম্যানেজার রে ডেলিয়ো বলেছেন যে যদি আমেরিকার আর্থিক ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়, তবে এটি একটি গুরুতর ঋণ সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স অনুমান করেছে যে যদি কাঠামোগত সংস্কার না হয়, তবে আগামী ত্রিশ বছরে জাতীয় ঋণ দ্বিগুণ হতে পারে। এর ফলে সরকারের প্রতিরক্ষা, অবকাঠামো এবং সামাজিক কর্মসূচিতে বিনিয়োগের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়বে।
কিঞ্চসের তত্ত্ব এবং আমেরিকার বাস্তবতা
খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কিঞ্চস বলেছিলেন যে যদি আপনার ব্যাংকে ছোট ঋণ থাকে, তবে এটি আপনার সমস্যা, কিন্তু যদি খুব বড় ঋণ থাকে, তবে এটি ব্যাংকের সমস্যা হয়ে যায়। আজ আমেরিকার অবস্থা ठीक এমনই, যেখানে তার ঋণ তার আয়ের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে গেছে।
কিঞ্চসের মতে, ঋণ নেওয়া ততটুকুই ঠিক যতটুকু আপনার ক্ষমতার মধ্যে। যখন ঋণ সীমার বাইরে চলে যায়, তখন এটি আর্থিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক সংকটের জন্ম দেয়। আমেরিকার সামনেও এমনই সংকট রয়েছে, যা সময় থাকতে সামাল দেওয়া প্রয়োজন।