এলন মাস্কের টেসলা ভারতে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে, আর এর সূচনা হবে জুলাই মাসে মুম্বাইতে প্রথম শোরুম উদ্বোধনের মাধ্যমে।
বিশ্বের অন্যতম আলোচিত উদ্যোক্তা এলন মাস্ক এবার ভারতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করতে চলেছেন। টেসলার প্রথম গাড়িগুলি ভারতে পৌঁছে গেছে এবং কোম্পানি মুম্বাইতে তাদের প্রথম শোরুম খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশাপাশি, তাঁর স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা স্টারলিঙ্ককেও ভারতে কাজ শুরু করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই দুটি প্রকল্প ভারতের অটোমোবাইল এবং ইন্টারনেট সংযোগের দৃশ্যপটে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
টেসলার ভারতে আগমনের আলোচনা বহু বছর ধরে চলে আসছিল, কিন্তু এবার সেই অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে। মাস্কের এই পরিকল্পনা এমন এক সময়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে যখন আমেরিকায় তাঁর রাজনৈতিক অবস্থাও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। এটা কি ভারতে তাঁর কৌশলগত উপস্থিতির সূচনা, নাকি বিশ্বব্যাপী চাপের প্রতিক্রিয়া? আসুন বিস্তারিত জেনে নেই।
টেসলার ভারতে প্রবেশ: অবশেষে খুলছে প্রথম শোরুম
টেসলা জুলাই ২০২৫ সালে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। কোম্পানি মুম্বাইতে তাদের প্রথম শোরুম খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে চালু হতে পারে। এরপর নয়াদিল্লীতেও শোরুম খোলা হবে। সূত্রের খবর, টেসলা আমেরিকা, চীন এবং নেদারল্যান্ডস থেকে সুপারচার্জারের যন্ত্রপাতি, অ্যাক্সেসরিজ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ভারতে আমদানি করেছে।
টেসলার প্রথম চালানের অধীনে পাঁচটি Model Y গাড়ি চীনের সাংহাই প্ল্যান্ট থেকে মুম্বাই পৌঁছে গেছে। এটি একটি রিয়ার-হুইল ড্রাইভ ইলেকট্রিক SUV, যা বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত ইলেকট্রিক গাড়িগুলির মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত।
ভারতে টেসলার উপস্থিতির সূচনা এই আমদানি করা গাড়িগুলি দিয়ে হবে, তবে কোম্পানি পরবর্তীকালে স্থানীয় উৎপাদনের ব্যাপারেও ভাবনাচিন্তা করতে পারে।
মূল্য এবং কর কাঠামো: একটি বড় চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে ভারতে সম্পূর্ণরূপে নির্মিত আমদানি করা গাড়িগুলিতে অত্যধিক শুল্ক আরোপ করা হয়। ৪০,০০০ ডলারের কম মূল্যের গাড়িগুলিতে ৭০ শতাংশ এবং তার বেশি মূল্যের গাড়িগুলিতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়।
ভারতে যা Model Y গাড়ি পৌঁছেছে, তাদের মূল মূল্য প্রায় ২৭.৭ লক্ষ টাকা বলে জানা গেছে, তবে তার উপর ২১ লক্ষ টাকার বেশি আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে একটি গাড়ির সম্ভাব্য মূল্য কর এবং অন্যান্য শুল্ক মিলিয়ে ৫৬,০০০ ডলার (প্রায় ৪৬ লক্ষ টাকা) এর বেশি হতে পারে।
টেসলা তাদের দাম কৌশলগতভাবে নির্ধারণ করবে যাতে তারা ভারতীয় গ্রাহকদের কাছে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে পারে।
টেসলার ভারত ভ্রমণ: একটি দীর্ঘ অপেক্ষা
টেসলার ভারতে প্রবেশ গত কয়েক বছর ধরে আটকে ছিল। প্রধান সমস্যা ছিল আমদানি শুল্ক এবং স্থানীয় উৎপাদন নিয়ে সরকার ও কোম্পানির মধ্যে মতবিরোধ। কিন্তু ফেব্রুয়ারী ২০২৫ সালে এলন মাস্কের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে দেখা করার পরে পরিস্থিতি ত্বরান্বিত হয়।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনের মতে, এই বৈঠকের পরেই টেসলা ভারতের জন্য গাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং এখন তারা তাদের শোরুম স্থাপন এবং বিক্রয় কার্যক্রমের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।
ডিজিটাল বিপ্লবের দিকে পদক্ষেপ: স্টারলিঙ্ককে অনুমতি দেওয়া হয়েছে
টেসলার পাশাপাশি, মাস্কের আরেকটি বড় কোম্পানি স্পেসএক্সও ভারতে তাদের উপস্থিতি জানাতে চলেছে। স্পেসএক্সের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা স্টারলিঙ্ককে ভারতে স্যাটেলাইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা শুরু করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
দূরসংযোগ বিভাগ (DoT) স্টারলিঙ্ককে GMPCS (গ্লোবাল মোবাইল পার্সোনাল কমিউনিকেশন বাই স্যাটেলাইট) লাইসেন্স প্রদান করেছে। এই লাইসেন্স তাদের ভারতে ইন্টারনেট সেবা প্রদানের আইনগত স্বীকৃতি দেয়। এখন কোম্পানি ২০২৫ সালের শেষের দিকে অথবা ২০২৬ সালের শুরুর দিকে ভারতে তাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারে।
দূরবর্তী এলাকায় পৌঁছাবে ইন্টারনেট
স্টারলিঙ্ক সেবা ভারতের সেসব গ্রামীণ এবং দূরবর্তী এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ সরবরাহ করার দাবি করে, যেখানে এখনও পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড বা মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছাতে পারেনি।
এই স্যাটেলাইট ভিত্তিক ব্যবস্থা ভারতের ডিজিটাল ফাঁক পূরণে সহায়ক হতে পারে। ওয়ানওয়েব এবং Jio স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনের পরে স্টারলিঙ্ক তৃতীয় এমন কোম্পানি হবে যাকে ভারতে এই ধরনের সেবা প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
তবে, এখনও কোম্পানিকে ভারতীয় মহাকাশ বিভাগের সংস্থা IN-SPACe থেকে চূড়ান্ত অনুমতি পেতে বাকি রয়েছে।
মাস্কের কৌশল: ট্রাম্প থেকে দূরত্ব, ভারতে ঘনিষ্ঠতা
এলন মাস্ক সম্প্রতি আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে তীব্র রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক টানাপড়েনের মধ্যে ছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে টেসলা এবং স্টারলিঙ্কের দ্রুত বর্ধমান পদক্ষেপকে অনেক বিশেষজ্ঞ বিশ্ব রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন।
ভারতে একটি শক্তিশালী ব্যবসায়িক উপস্থিতি থেকে মাস্ক আমেরিকার শাসকবর্গের উপর পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করতে পারেন এবং পাশাপাশি একটি উদীয়মান বাজারে লাভের নতুন দ্বার খুলতে পারেন। ক্রিকেটের ভাষায় বললে, মাস্ক ট্রাম্পের সামনে তাঁর ‘দ্বিতীয়’ বোলিং করেছেন – একটি চমকপ্রদ কৌশল।
ভারতের জন্য সম্ভাবনাময় সুযোগ
ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অটোমোবাইল বাজার এবং এখানে ইলেকট্রিক যানবাহনের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারও ইভি নীতিকে উৎসাহ দিচ্ছে।
টেসলার উপস্থিতি ভারতীয় গ্রাহকদের বিশ্বমানের প্রযুক্তির অভিজ্ঞতা দেবে, পাশাপাশি ভারতে ইভি বাজারে প্রতিযোগিতাও বাড়বে।
অন্যদিকে, স্টারলিঙ্কের আগমন গ্রাম এবং পিছিয়ে পড়া এলাকায় ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্নকে গতি দেবে।