আজকের দ্রুতগতির জীবনে, ঘুমের প্রতি প্রায়শই মানুষজন নজর দেয় না। অফিসের চাপ, সোশ্যাল মিডিয়া, গভীর রাতের স্ক্রিন টাইম বা জীবনযাত্রার অনিয়ম - এইসব কারণে আমাদের ঘুম সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু আপনি কি জানেন যে প্রতিদিন ৬ ঘণ্টার কম ঘুমানো শুধু ক্লান্তি বা আলস্য নয়, বরং অনেক গুরুতর রোগের কারণ হতে পারে?
একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতে ৬০% মানুষ রাতে ছয় ঘণ্টার কম ঘুমায়। এই সংখ্যাটি কেবল একটি স্বাস্থ্য প্রতিবেদন নয়, বরং একটি অ্যালার্ম - যা আমাদের সতর্ক করে যে এখন আমাদের ঘুমকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়া একটি বিপজ্জনক সংকেত
ঘুম আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউনিটি) বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন আমরা ঠিকমতো ঘুমাই না, তখন আমাদের শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে সাইটোকাইনস (এক ধরণের প্রোটিন যা সংক্রমণ থেকে লড়াই করতে সাহায্য করে) তৈরি করতে পারে না। ফলস্বরূপ, আমরা দ্রুত অসুস্থ হই এবং ছোটখাটো রোগও দীর্ঘ সময় ধরে ভোগায়।
এছাড়াও, ঘুমের অভাব স্থূলতাও বাড়িয়ে তোলে। গবেষণা দেখায় যে কম ঘুমোনোর লোকেদের মধ্যে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন যেমন 'ঘ্রেলিন' এবং 'লেপ্টিন'-এর ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়, যা অস্বাস্থ্যকর আকাঙ্ক্ষা এবং অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করে।
হৃদরোগের ওপর সরাসরি প্রভাব
হৃদরোগ আজ ভারতে মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এটা জেনে অবাক হবেন যে, ঘুমের অভাব, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের ভারসাম্যহীনতা এবং হার্ট অ্যাটাকের মতো সমস্যার সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।
যখন আমরা গভীর ঘুমে থাকি, তখন আমাদের শরীর রক্তচাপ এবং হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু যখন ঘুম পরিপূর্ণ হয় না, তখন এই ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। এর ফলে হৃদপিণ্ডের ওপর অবিরাম চাপ পড়ে, যা ধীরে ধীরে গুরুতর রোগের জন্ম দেয়।
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব
ঘুম শুধু শরীরের নয়, মস্তিষ্কের মেরামত করারও সময় দেয়। যখন আপনি পর্যাপ্ত ঘুমোন না, তখন মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কমে যায়। মনোযোগের অভাব, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস এবং স্মৃতিশক্তি দুর্বল হওয়া সাধারণ লক্ষণ।
এছাড়াও, ঘুমের অভাব মানসিক সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে। যেমন:
- স্ট্রেস (Stress): ঘুম না হলে মানসিক চাপের মাত্রা বাড়ে।
- অ্যাংজাইটি এবং ডিপ্রেশন: দীর্ঘদিন ধরে কম ঘুমানো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে।
- মুড সুইংস এবং খিটখিটে মেজাজ: অল্পতেই রাগ হওয়া বা বিনা কারণে বিষণ্ণতা অনুভব করা এর লক্ষণ হতে পারে।
ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়ে
খুব কম লোকই জানেন যে ঘুমের অভাব শরীরের ইনসুলিনের কার্যকারিতা প্রভাবিত করে। ফলস্বরূপ, রক্তের শর্করার মাত্রা ভারসাম্যহীন হয়ে যায় এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
বিশেষ করে যারা শিফট ওয়ার্ক করেন বা সারারাত জেগে থাকেন, তাদের শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধের (ইনসুলিন রেজিস্টেন্স) সম্ভাবনা বেশি থাকে।
ঘুমের উন্নতির জন্য এই অভ্যাসগুলো অনুসরণ করুন
- ঘুমানো এবং ঘুম থেকে ওঠার সময় নির্ধারণ করুন: প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো এবং ওঠা শরীরের ঘড়িকে স্থিতিশীল করে।
- ঘুমানোর আগে স্ক্রিন টাইম কমান: মোবাইল বা ল্যাপটপের নীল আলো ঘুমের হরমোন 'মেলাটোনিন'-এর পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
- ক্যাফিন এবং ভারী খাবার ত্যাগ করুন: রাতে কফি বা ভারী খাবার আপনার ঘুমকে ব্যাহত করতে পারে।
- মেডিটেশন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন: মনকে শান্ত করার জন্য ধ্যান এবং গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার অভ্যাস করুন।
- ঘুমের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করুন: শোবার ঘর শান্ত, অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং ঠান্ডা হলে ঘুম দ্রুত এবং গভীর হয়।
ঘুম কোনো আলস্য বা সময়ের অপচয় নয়, বরং একটি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যগত চাহিদা। আপনি যদি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী রাখতে চান, হৃদরোগমুক্ত থাকতে চান, মানসিক অবস্থা স্থিতিশীল রাখতে চান এবং জীবনে শক্তি বজায় রাখতে চান - তাহলে আজ থেকেই ঘুমকে আপনার অগ্রাধিকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন।