আর্য় সমাজের ১৫০ বছর: স্বামী দয়ানন্দের বিপ্লবী দর্শন ও অবদান

🎧 Listen in Audio
0:00

১০ এপ্রিল ১৮৭৫, এই দিনটিতে বিপ্লবী চিন্তাবিদ স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই)তে আর্য় সমাজের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। "কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্" (বিশ্বকে আর্য় করে তুলুন) মূলমন্ত্র ধারণ করে আর্য় সমাজ বৈদিক তত্ত্বের মাধ্যমে সমাজে বিপ্লবী পরিবর্তন আনার সঙ্কল্প গ্রহণ করেছিল। এই বছর আর্য় সমাজ তার প্রতিষ্ঠার ১৫০ বছর পূর্ণ করছে।

আর্য় সমাজের প্রতিষ্ঠা কেন?

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী যখন ভারতীয় সমাজ জাতিপাত, অন্ধবিশ্বাস এবং সামাজিক বৈষম্যে জর্জরিত ছিল, সেই সময় আর্য় সমাজের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বৈদিক জ্ঞানকে সমাজ সংস্কারের ভিত্তি বানিয়ে সত্য, নীতি ও সমতা ভিত্তিক নতুন ভারতের কল্পনা করেছিলেন।

আর্য় সমাজের প্রধান বৈচারিক তত্ত্বাবলী

- সমতা ও মানবতার তত্ত্ব: "মানুষ এক জাতি" তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে আর্য় সমাজ জন্মগত জাতিব্যবস্থাকে অস্বীকার করেছিল।
- কর্মভিত্তিক বর্ণ ব্যবস্থা: "কর্মণ্য বর্ণ ব্যবস্থা" গ্রহণ করে সকলকে সমান শিক্ষা ও উন্নতির অধিকার প্রদান করা হয়েছিল, বিশেষ করে দলিত, নারী ও বঞ্চিত শ্রেণীর জন্য।
- বৈদিক শিক্ষা ও ভাষা: সংস্কৃত ও শুদ্ধ হিন্দিতে বেদের প্রচার করে গুরুকুল পরম্পরাকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছিল।

স্বাধীনতা সংগ্রামে আর্য় সমাজের ভূমিকা

‘সত্যার্থ প্রকাশ’ যে রচনাটি বিপ্লবীদের গীতা বলে বিবেচিত হয়, সেই গ্রন্থ হাজার হাজার স্বাধীনতা সেনানীকে প্রেরণা জুগিয়েছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতের ৮০% বিপ্লবী আর্য় সমাজ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী সর্বপ্রথম ‘স্বরাজ’ (আত্মশাসন) এর ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার স্বদেশী তত্ত্ব ভারতীয় অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মূল ভিত্তি থাকে।

সামাজিক সংস্কার ও প্রভাব

আর্য় সমাজ নিম্নলিখিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান চালিয়েছিল:
১. সতীপ্রথা
২. শিশু বিবাহ
৩. দেওয়ালি প্রথা
৪. জাতি বৈষম্য
৫. নারী নিরক্ষরতা

১৯২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার যে শারদা আইন (শিশু বিবাহ নিষেধাজ্ঞা আইন) পাস করেছিল, তার পেছনে আর্য় সমাজের নেতা হরবিলাস শারদার প্রচেষ্টা ছিল। শুদ্ধি আন্দোলনের মাধ্যমে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত লোকদের ঘরে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, বিশেষ করে মেওয়াত অঞ্চলে।

ভাষা, সংস্কৃতি ও গো-সংরক্ষণ

স্বামী দয়ানন্দ সংস্কৃত ও হিন্দির প্রচার-প্রসারকে তার লক্ষ্য বানিয়েছিলেন। তিনি "গো করুণানিধি" গ্রন্থে গো-সংরক্ষণকে ভারতীয় গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলে উল্লেখ করেছেন। যজ্ঞ ও যোগকে জীবনধারা বানিয়ে ‘সুস্থ ভারত’ এর কল্পনা প্রদান করা হয়েছিল।

বিশ্বব্যাপী বার্তা

আর্য় সমাজের দর্শন শুধুমাত্র ভারতে সীমাবদ্ধ থাকে নি। এর শিক্ষা – বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, মানব সমতা ও সত্যের প্রতি প্রতিশ্রুতি – আজ বিশ্বব্যাপী প্রাসঙ্গিক। শিক্ষা, পরিবেশ, মানবাধিকার ও নৈতিক জীবন যে ক্ষেত্রগুলিতে আর্য় সমাজের ছাপ স্পষ্ট।

প্রধান তথ্য (Quick Facts)

প্রতিষ্ঠা: ১০ এপ্রিল ১৮৭৫
প্রতিষ্ঠাতা: স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী
মুখ্য কার্যালয়: মূলত মুম্বাই, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বিকাশ
মূলমন্ত্র: কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্
প্রধান গ্রন্থ: সত্যার্থ প্রকাশ
প্রধান অবদান: স্বাধীনতা সংগ্রাম, নারী শিক্ষা, দলিত উন্নয়ন, বৈদিক সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ

জীবন্ত পরম্পরার অমর ঐতিহ্য

আর্য় সমাজ আজও বিশ্বজুড়ে স্কুল, কলেজ, গুরুকুল ও সংস্কার কেন্দ্রের মাধ্যমে সক্রিয়। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী শুধুমাত্র একজন ঋষি ই নন, বরং আধুনিক ভারতের শিল্পী ও ছিলেন। তার জীবন এই ব্যাপারটির প্রমাণ যে কিভাবে প্রাচীন বৈদিক জ্ঞান আধুনিক সমাজে একটি নতুন চেতনা জাগ্রত করতে পারে।

Leave a comment