চীন দুর্লভ পৃথিবীর উপাদান (REE) -এর ব্যবসায় এমন একচেটিয়া আধিপত্য স্থাপন করেছে যে আজ বিশ্বের কোনও দেশই তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছে না।
গত তিন দশকে বিশ্ববাজারে খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটেছে, তা হল চীনের দুর্লভ পৃথিবীর উপাদান (REE) -এর ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব আধিপত্য। এই ১৭ টি দুর্লভ উপাদান আজ প্রতিটি আধুনিক প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য, চাই সেটি স্মার্টফোন হোক বা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। তাই প্রশ্ন হল, কিভাবে চীন এই ক্ষেত্রের অনন্য নেতা হয়ে উঠল এবং ভারতের মতো দেশগুলি কেন এখনও সংগ্রাম করছে?
দুর্লভ পৃথিবীর উপাদান নিয়ন্ত্রণে চীন
১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চীন ও আমেরিকার দুর্লভ পৃথিবীর উপাদান উৎপাদন প্রায় সমান ছিল, কিন্তু ২০২৪ সাল নাগাদ চীনের উৎপাদন আমেরিকার চেয়ে ছয়গুণ বেশি হয়ে গেছে। এই নয়, চীন সম্পূর্ণ বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলেও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছে। খনন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ এবং চুম্বক নির্মাণ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে চীনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ (USGS) -এর মতে, চীনের দুর্লভ পৃথিবীর উপাদান উৎপাদন গত ৩০ বছরে নয়গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ববাজারে রপ্তানিতেও ২০২৩ সালে তার অংশীদারিত্ব ৬৩% এ পৌঁছেছে, যা ২০২২ সালে ছিল ৫৬.৬%। আমেরিকা, ভারত ও জাপানের মতো দেশগুলি এখন ৮০% এর বেশি দুর্লভ পৃথিবীর উপাদান চীন থেকে আমদানি করে।
সরকারি অনুদান এবং দামের কৌশলগত কৌশল
চীনের সাফল্যের একটি বড় কারণ হল সরকারি উৎসাহ এবং পরিকল্পিত নীতি। চীনা কোম্পানিগুলিকে প্রচুর অনুদান দেওয়া হয়েছে, যার ফলে তারা বিশ্ববাজারে অত্যন্ত কম দামে পণ্য বিক্রি করতে পেরেছে। এর ফলে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলির কোম্পানিগুলি টিকতে পারেনি এবং তাদের খনন কার্যকলাপ বন্ধ করতে হয়েছে।
২০১০ সালে আমেরিকার মাউন্টেন পাস মাইনের বন্ধ হওয়া এই কৌশলের একটি বড় উদাহরণ। এর পর চীন তার আধিপত্য আরও গভীর করেছে এবং বিশ্ববাজারকে নিজের উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে।
ভারতের অবস্থা: ভান্ডার আছে, কিন্তু ব্যবহার নেই
ভারতের কাছে দুর্লভ পৃথিবীর উপাদানের বিশাল ভান্ডার আছে। USGS -এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের কাছে প্রায় ৬.৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন মজুত আছে, যা বিশ্বে তৃতীয় স্থানে। কিন্তু উৎপাদন ও ব্যবসায় ভারতের অংশগ্রহণ খুবই নগণ্য। ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারতের মোট দুর্লভ পৃথিবীর উপাদান রপ্তানি মাত্র ৫৪ মিলিয়ন ডলার ছিল, যখন চীন একই সময়ে ৭৬৩ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে।
ভারতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল প্রযুক্তি ও প্রক্রিয়াকরণ অবকাঠামোর অভাব। এটাই কারণ যে ভারত তার মোট দুর্লভ পৃথিবীর উপাদান আমদানির ৯৬.৯% চীন থেকে করে। এই নির্ভরতা ২০২২ সালে ৭৮.৩% ছিল, যা আজ আরও বেড়েছে।
চীনের সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার বিশ্বব্যাপী প্রভাব
এপ্রিল ২০২৪ সালে চীন জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে দুর্লভ পৃথিবীর উপাদানের চুম্বক রপ্তানিতে কঠোর শর্ত আরোপ করেছে। এখন প্রতিটি রপ্তানির জন্য বিস্তারিত তথ্য দিতে হয়, যেমন এই পণ্যগুলি কোথায় যাচ্ছে, কার জন্য, এবং অনেক ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের পরীক্ষাও জরুরী হয়ে উঠেছে।
এর প্রভাব বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে স্পষ্ট দেখা গেছে। ইলেকট্রিক যানবাহন তৈরির কোম্পানি যেমন টেসলা, টয়োটা এবং BYD -এর সরবরাহে সমস্যা হয়েছে। ইলেকট্রনিক্স ক্ষেত্রে ল্যাপটপ এবং মোবাইল ফোনের উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়েছে। প্রতিরক্ষা খাতে, যেখানে এই উপাদানগুলি ক্ষেপণাস্ত্র নির্দেশ ব্যবস্থা এবং রাডারে ব্যবহৃত হয়, সেখানে সংকট আরও গভীর হয়েছে।
ভারতের জন্য কি আছে বিকল্প?
ভারতকে এখন জেগে উঠতে হবে। যদি আমরা আমাদের বিশাল ভান্ডারের সঠিক ব্যবহার করতে চাই, তাহলে আমাদের কৌশলগত এবং দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
খনন ও প্রক্রিয়াকরণে বিনিয়োগ
ভারতকে তার দেশীয় খনন ও প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে হবে। এখন ভারতের কাছে অত্যাধুনিক প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর তীব্র অভাব রয়েছে। এর জন্য সরকার ও বেসরকারি খাতকে একত্রে বিনিয়োগ করতে হবে।
চীনের উপর নির্ভরতা কমানো
ভারতকে তার আমদানি বৈচিত্র্যপূর্ণ করতে হবে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও জাপানের মতো দেশগুলির সাথে অংশীদারিত্ব করে ভারতকে বিকল্প উৎস উন্নত করতে হবে। তদুপরি, ভারতকে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেকে একটি শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
ডাউনস্ট্রিম শিল্পে মনোযোগ
শুধুমাত্র কাঁচামালের উৎপাদন যথেষ্ট নয়। ভারতকে দুর্লভ পৃথিবীর উপাদানের চুম্বক, মোটর এবং অন্যান্য পণ্য তৈরিতেও পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে শুধুমাত্র মূল্যবর্ধনই হবে না, ভারত বিশ্ববাজারে সরবরাহ শৃঙ্খলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশও হয়ে উঠবে।
গবেষণা ও উন্নয়নে উৎসাহ
দুর্লভ পৃথিবীর উপাদান প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি অত্যন্ত জটিল। ভারতকে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে যাতে নতুন, সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা যায়। IIT এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠানগুলিকে এই ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উৎসাহ দেওয়া জরুরী।
বিশ্ববাজারে ভারতের অবস্থান
বিশ্বজুড়ে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং আমেরিকার মত অর্থনীতি চীনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করছে। আমেরিকা তাদের মাউন্টেন পাস মাইন পুনরায় চালু করেছে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে, কিন্তু তারপরেও চীনের আধিপত্য ভেঙে পড়ছে বলে মনে হয় না।
ভারতের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা। যদি আমরা এখনও জেগে না উঠি, তাহলে আগামী দশকগুলিতে আমরা শুধুমাত্র ক্রেতা হয়ে থাকব, উৎপাদক নয়।
```