‘টাইগার ম্যান’ ভাল্মীকি থাপারের মৃত্যু: বাঘ সংরক্ষণের এক যুগের অবসান

🎧 Listen in Audio
0:00

ভারতের বিখ্যাত বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ এবং ‘টাইগার ম্যান’ নামে পরিচিত ভাল্মীকি থাপার ৩১শে মে, ২০২৫ সকালে ৭৩ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন এবং অবশেষে এই মারাত্মক রোগের কাছে পরাজিত হন।

Valmik Thapar Passes Away: ভারতের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ক্ষেত্রে এক যুগের অবসান ঘটেছে। আজ, ৩১শে মে, ২০২৫ সকালে ৭৩ বছর বয়সে দেশের বিখ্যাত বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, লেখক এবং প্রকৃতিপ্রেমী ভাল্মীকি থাপারের মৃত্যু হয়। বাঘ সংরক্ষণে তার নিঃস্বার্থ সেবা ও প্রচেষ্টার জন্য তাকে সমগ্র ভারত এবং বিশ্বব্যাপী সম্মানিত করা হতো।

‘ইন্ডিয়ার টাইগার ম্যান’ নামে পরিচিত ভাল্মীকি থাপার কেবল বাঘ বাঁচানোর একটি অভিযানই গ্রহণ করেননি, বরং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে জ্ঞান ও সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজও করেছেন। তার মৃত্যুতে কেবল বন্যপ্রাণী প্রেমীরা নয়, প্রকৃতিও একজন আন্তরিক বন্ধুকে হারিয়েছে।

বাঘের প্রতি প্রেমের সূত্রপাত ও জীবনের নতুন মোড়

ভাল্মীকি থাপারের জন্ম ১৯৫২ সালে এক জ্ঞানী পরিবারে। তার পিতা রোমেশ থাপার ছিলেন একজন বিখ্যাত সাংবাদিক ও চিন্তাবিদ, আর তার কাকী রোমিলা থাপার ছিলেন ইতিহাসের একজন বিখ্যাত পণ্ডিতা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করার পর ভাল্মীকি শশী কাপুরের মেয়ে সঞ্জনা কাপুরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় মোড় আসে যখন ১৯৭৬ সালে তিনি প্রথমবার রণথম্ভর জাতীয় উদ্যান পরিদর্শন করেন।

বন্যপ্রাণীর এই সুন্দর ভূমিতে প্রথমবার বাঘের সাথে দেখা তার হৃদয়ে এমন এক প্রেম জাগ্রত করে, যা তার পুরো জীবনের পথ নির্ধারণ করে দেয়। এই অভিজ্ঞতার পর তিনি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের অন্যতম নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা হয়ে ওঠেন।

রণথম্ভরের আন্তরিক বন্ধু

রণথম্ভরের সাথে ভাল্মীকি থাপারের সম্পর্ক প্রায় ৪০ বছর ধরে চলে। তিনি এই অঞ্চলে উপস্থিত বাঘের কার্যকলাপ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং অনেক বাঘের গল্প বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে ‘মছলি’ নামক বাঘিনীর কথা উল্লেখযোগ্য, যাকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ছবি তোলা বাঘিনী বলে মনে করা হয়। ভাল্মীকি কেবল মছলির জীবন ক্যামেরায় বন্দী করেননি, বরং তার চ্যালেঞ্জ এবং অস্তিত্বের লড়াইয়ের বিষয়টিও সংবেদনশীলতার সাথে ব্যাখ্যা করেছেন।

রণথম্ভর ছাড়াও তিনি সমগ্র ভারতে বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সরকার ও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অবৈধ শিকার ও প্রাকৃতিক আবাসস্থলের সংকট নিয়ে তিনি বারবার কথা বলেছেন, যার ফলে বাঘ সংরক্ষণের দিকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

লেখক, ফটোগ্রাফার ও ডকুমেন্টারি নির্মাতা হিসেবে অবদান

ভাল্মীকি থাপার কেবল বন্যপ্রাণী প্রেমী বা সংরক্ষক ছিলেন না, বরং একজন প্রতিভাবান লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতাও ছিলেন। তিনি ৪০টিরও বেশি বই লিখেছেন, যার মধ্যে ‘Land of the Tiger’, ‘Tiger Fire’, এবং ‘The Secret Life of Tigers’ বিশেষভাবে বিখ্যাত। এই বইগুলিতে তিনি বাঘের জীবন, তাদের আচরণ এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকভাবে তুলে ধরেছেন।

এছাড়াও, তিনি বিবিসি এবং অন্যান্য অনেক আন্তর্জাতিক চ্যানেলের জন্য বন্যপ্রাণী নিয়ে অনেক ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন। তার এই চলচ্চিত্রগুলি কেবল ভারতেই নয়, বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তার ডকুমেন্টারিগুলিতে বাঘের সংগ্রাম, প্রকৃতির সাথে তাদের লড়াই এবং সংরক্ষণের চ্যালেঞ্জগুলি অত্যন্ত আবেগপূর্ণ এবং জীবন্তভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

বাঘের প্রতি সমর্পণ এবং জনগণকে সচেতন করার অভিযান

ভাল্মীকি থাপার তার জীবন বাঘ এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। তিনি সবসময় সরকার এবং সাধারণ জনগণের কাছে বাঘ সংরক্ষণের জন্য সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বাঘের প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা, অবৈধ শিকার রোধ এবং পরিবেশগত পর্যটনের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও সক্রিয় ছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল, বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ হলেই প্রকৃতি এবং মানবজীবনের ভারসাম্য সম্ভব।

তার কাজ কেবল সংরক্ষণ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তিনি বন্যপ্রাণীর প্রতি সমাজে সম্মান ও ভালোবাসার অনুভূতি জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন। তিনি বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন এবং যুব প্রজন্মকে এই দিকে অবদান রাখার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন।

শেষ মুহূর্ত ও অপূর্ণ স্বপ্ন

যদিও ভাল্মীকি থাপার ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন, তবুও তিনি কখনো তার লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে আপোষ করেননি। তার মৃত্যু কেবল একজন ব্যক্তির মৃত্যু নয়, বরং এক অভিযান, এক আওয়াজের অবসান যা ভারতের বাঘ রক্ষা করত। তার পরিবার, সহকর্মী বন্যপ্রাণী প্রেমী ও সংরক্ষণ কর্মীরা তার শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ করে শ্রদ্ধাঞ্জলি अर्पণ করছেন। তার মৃত্যুতে প্রকৃতিপ্রেমী এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কাজ করা ব্যক্তিদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

Leave a comment