শহীদ ভগত সিং: ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান বিপ্লবী

🎧 Listen in Audio
0:00

শহীদ ভগত সিং ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান বিপ্লবী এবং যুব সমাজের অনুপ্রেরণার প্রতীক। তাঁর জন্ম হয় আজ, ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯০৭ সালে পাঞ্জাবের লায়ালপুর জেলার (যা এখন পাকিস্তানে) বাঙ্গা গ্রামে। তাঁর পুরো নাম ছিল ভগত সিং এবং তিনি একটি শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল কিষাণ সিং সান্ধু এবং মাতার নাম ছিল বিদ্যাবতী কৌর।

প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা

ভগত সিং-এর পরিবার ছিল একটি শিখ পরিবার, যাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। তাঁর দাদু এবং কাকাও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ভগত সিং শৈশব থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে কাজ করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তিনি পাঞ্জাবের স্থানীয় বিদ্যালয়ে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর উচ্চশিক্ষা শুরু করেন, যেখানে তিনি রাজনীতি ও সমাজতত্ত্বের মতো বিষয়গুলোতে আগ্রহ তৈরি করেন।

বিপ্লবী কার্যকলাপ

ভগত সিং-এর জীবন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়ে আসে। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নীতিতে অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং তিনি আরও জঙ্গি ও বিপ্লবী পদ্ধতিতে স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন। তিনি হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (HRSA) এবং পরে হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন (HSRA)-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিপ্লবী কার্যকলাপ আরও জোরদার করেন।

* কারাগারে থাকা ও লেখালেখি: ভগত সিং কারাগারে থাকাকালীন অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ও বই লিখেছেন। তিনি তাঁর বইতে সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ এবং ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাঁর মতামত প্রকাশ করেছেন। তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ "Why I am an Atheist" (আমি কেন নাস্তিক) কারাগারে থাকাকালীনই লেখা, যেখানে তিনি ধর্মের প্রতি তাঁর নেতিবাচক ধারণা এবং সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

* দিল্লি বিধানসভা বোমা হামলা: ১৯২৯ সালে ভগত সিং এবং তাঁর সহযোগী শিবরাম রাজগুরু দিল্লি বিধানসভায় বোমা নিক্ষেপ করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় সরকারকে আতঙ্কিত করা। যদিও, তাঁরা এই হামলায় কাউকে মারতে চাননি, বরং তাঁরা শুধুমাত্র দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। এই ঘটনার পর ভগত সিং ও তাঁর সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করা হয়।

* লাহোর ষড়যন্ত্র: ১৯২৮ সালে লাহোরে এক পুলিশ অফিসার জে.পি. সন্ডার্স-এর হত্যার ঘটনায় ভগত সিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সন্ডার্স-এর হত্যার উদ্দেশ্য ছিল লালা লাজপত রায়-এর হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া, যিনি ব্রিটিশ পুলিশের দ্বারা মারধরের পরে মারা গিয়েছিলেন।

শহীদ ও ফাঁসি

ভগত সিং-এর গ্রেফতারির পর তাঁর উপর একটি কঠোর মামলা চালানো হয়। তাঁর সঙ্গে তাঁর সহযোগী রাজগুরু এবং সুখদেবকেও ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়। তাঁদের বিচার এবং পরবর্তী ঘটনা ভারতীয় জনগণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাঁদের অনুভূতিকে আরও শক্তিশালী করেছিলেন। ভগত সিং, সুখদেব এবং রাজগুরুকে ২৩শে মার্চ, ১৯৩১ সালে ফাঁসি দেওয়া হয়।

তাঁদের চিন্তা

ভগত সিং তাঁর জীবনভর তাঁর চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, ভারতীয় সমাজে সব ধরনের বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিত। তিনি আরও মনে করতেন যে, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধুমাত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়, বরং সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য, জাতিভেদ এবং সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধেও এই সংগ্রাম হওয়া উচিত।

শহীদের প্রভাব

ভগত সিং-এর আত্মত্যাগ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন পথে চালিত করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর আদর্শ ও সংগ্রাম ভারতীয় যুবকদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। তাঁর আত্মত্যাগ ও সাহস স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও দ্রুততর করেছিল এবং ভারতীয় জনগণকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আরও বেশি সংগ্রামী করে তুলেছিল।

ভগত সিং আজও ভারতীয় ইতিহাসে এক অমর এবং প্রেরণাদায়ক নেতা হিসেবে স্মরণীয়। তাঁর আত্মত্যাগ এবং তাঁর চিন্তা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সবসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে।

ভগত সিং-এর বিখ্যাত স্লোগান

ভগত সিং-এর অনেক বিখ্যাত স্লোগান ছিল, যা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই স্লোগানগুলি কেবল তাঁর সাহস ও দেশপ্রেমকেই প্রকাশ করত না, বরং ভারতীয় সমাজে বিপ্লবী চেতনাও ছড়িয়ে দিত। এখানে ভগত সিং-এর কিছু বিখ্যাত স্লোগান দেওয়া হল:

* "ইনকিলাব জিন্দাবাদ"
এই স্লোগানটি ভগত সিং এবং তাঁর সহযোগী রাজগুরু ও সুখদেব দ্বারা খুব বিখ্যাত হয়েছিল। "ইনকিলাব জিন্দাবাদ"-এর অর্থ হল "বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক"। এই স্লোগানটি আজও ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক এবং ভারতের বিভিন্ন আন্দোলনে ব্যবহৃত হয়।

* "সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা"
এই স্লোগানটি বিখ্যাত গান "সারে জাহাঁ সে আচ্ছা"-এর অংশ ছিল, যা ভগত সিং তাঁর আত্মত্যাগের আগে গেয়েছিলেন। এই স্লোগানটি তাঁর দেশপ্রেম এবং হিন্দুস্তানের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করে।

* "আমাদের অধিকারের জন্য লড়াই করাই আমাদের সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা"
ভগত সিং-এর এই স্লোগানটি তাঁর অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি অটল বিশ্বাসকে প্রকাশ করে। তিনি মনে করতেন যে, আসল স্বাধীনতা কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, বরং সমাজে সমতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতেও হওয়া উচিত।

* "যদি রাজি হও তবে খোদা রাজি, আর যদি খোদা রাজি না-ও হন, তবে আমরা সবাইকে রাজি করিয়ে নেব"
এই স্লোগানে ভগত সিং-এর আত্মবিশ্বাস এবং তাঁর চিন্তাভাবনা প্রয়োগ করার ক্ষমতা প্রকাশ পায়। তিনি মনে করতেন যে, যদি উদ্দেশ্য সঠিক হয়, তবে যেকোনো বাধা বা সমস্যা অতিক্রম করা সম্ভব।

* "সিংহের গর্জনের সাথে, বাঁদরের কিচিরমিচিরের তুলনা করো না"
এই স্লোগানটি তাদের জন্য ছিল, যারা বিপ্লবী কার্যকলাপ ও সংগ্রামের গুরুত্ব বোঝে না। ভগত সিং-এর এই বার্তা ছিল যে, আসল সংগ্রাম সেটাই, যা সমাজে পরিবর্তন আনে, সাধারণ কার্যকলাপ নয়, যা কোনো পরিবর্তনের কারণ হয় না।

Leave a comment