পৃথিবী দিবস ২০২৫: প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং আমাদের দায়িত্ব

🎧 Listen in Audio
0:00

প্রতি বছর ২২শে এপ্রিল পুরো বিশ্বে পৃথিবী দিবস (Earth Day) পালিত হয়। এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা যার উপর বাস করি, তা কোন সাধারণ স্থান নয়, বরং আমাদের একমাত্র গৃহ। এখানেই আমরা জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় বায়ু, জল, খাদ্য এবং সম্পদ পাই। কিন্তু প্রশ্ন হল – কি আমরা এর যথাযথ যত্ন নিচ্ছি?

আজকের যুগে যখন প্রকৃতি সংকটের মুখে, হিমবাহ গলে যাচ্ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্লাস্টিক সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, তখন আমাদের নিজেদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে হবে – আমরা কি করছি? এবং আমরা কি করতে পারি?

পৃথিবী দিবসের সূচনা কিভাবে হয়েছিল?

পৃথিবী দিবস প্রথম ১৯৭০ সালে আমেরিকায় পালিত হয়েছিল। সে সময় আমেরিকায় দ্রুততার সাথে শিল্পায়ন হচ্ছিল। কারখানার ধোঁয়া, নদীতে ফেলা আবর্জনা এবং বন ধ্বংসের ফলে পরিবেশ বিপদের মুখে পড়েছিল। এই সমস্যাগুলি বিবেচনা করে আমেরিকান সিনেটর গেলোর্ড নেলসন (Gaylord Nelson) মানুষকে পরিবেশের প্রতি উদ্বিগ্ন করার জন্য একটি দিন নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছিলেন – এবং এইভাবে ২২শে এপ্রিল 'Earth Day' হিসেবে পালনের সূচনা হয়।

প্রথম Earth Day-এ প্রায় ২ কোটি আমেরিকান নাগরিক রাস্তায় নেমেছিলেন – সমাবেশ, বিক্ষোভ, পোস্টার এবং সভাগুলির মাধ্যমে তারা পরিবেশ রক্ষার বার্তা দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন আমেরিকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। আজ ১৯০টিরও বেশি দেশ Earth Day পালন করে এবং কোটি কোটি মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে।

পৃথিবী দিবস কেন গুরুত্বপূর্ণ?

আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, বন উচ্ছেদ এবং প্লাস্টিকের আবর্জনা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি আমরা সময়মতো সচেতন না হই, তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্ম একটি অসুস্থ, দূষিত এবং অস্থির পৃথিবীতে বাস করতে বাধ্য হবে। পৃথিবী দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে প্রকৃতির যত্ন নেওয়া আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব – কারণ যদি প্রকৃতি না বাঁচে, তাহলে আমরাও বাঁচতে পারব না।

আজ পৃথিবী কোন কোন বিপদের মুখোমুখি?

গত কয়েক বছরে আমাদের পৃথিবী অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নীচে কিছু বড় সমস্যা তুলে ধরা হল, যার উপর আমাদের মনোযোগ দিতে হবে:

  1. জলবায়ু পরিবর্তন – পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রের जलস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আবহাওয়া অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। কখনো অত্যধিক তাপ, কখনো হঠাৎ বন্যা – এগুলির সবই এর প্রভাব।
  2. বায়ু এবং জল দূষণ – কারখানা এবং গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করছে। নদী এবং সমুদ্রে প্লাস্টিক এবং ময়লা ফেলা হচ্ছে।
  3. গাছ কাটা – বন কাটা হচ্ছে, যার ফলে শুধুমাত্র প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে না, বরং অক্সিজেন সরবরাহকারী গাছও কমে যাচ্ছে।
  4. জীববৈচিত্র্যের অভাব – অনেক পাখি, প্রাণী এবং উদ্ভিদ বিলুপ্ত হচ্ছে, কারণ তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে গেছে।

পৃথিবী দিবস ২০২৫-এর থিম: 'Planet vs. Plastics'

প্রতি বছর Earth Day-এর একটি থিম থাকে, এবং ২০২৫-এর থিম হল – “Planet vs. Plastics” অর্থাৎ পৃথিবী বনাম প্লাস্টিক। এই থিমটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর ফোকাস করে – প্লাস্টিক দূষণ। আজ প্লাস্টিক আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে – বোতল, থলি, স্ট্র, ব্রাশ, খেলনা, প্যাকেজিং… প্রায় সব কিছুতেই প্লাস্টিক আছে।

কিন্তু একই প্লাস্টিক এখন আমাদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে। এটি নদী, সমুদ্র এবং ভূমি দূষিত করে। প্রাণীদের পেটে গিয়ে তাদের মেরে ফেলে। এবং মাইক্রোপ্লাস্টিক আকারে এটি এখন আমাদের বায়ু, জল এবং খাদ্যেও প্রবেশ করেছে।

আমরা কি করতে পারি? ছোটো পদক্ষেপ, বড় প্রভাব

পৃথিবী দিবসে শুধুমাত্র বক্তৃতা দেওয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি আপলোড করা যথেষ্ট নয়। যদি সত্যিকারের পরিবর্তন আনা হয়, তাহলে আমাদের আমাদের জীবনে কিছু ব্যবহারিক পরিবর্তন আনতে হবে।

১. প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে দিন

  • প্লাস্টিকের থলির পরিবর্তে কাপড় বা পাটের থলি ব্যবহার করুন।
  • পানি পান করার জন্য স্টিল বা কাচের বোতল ব্যবহার করুন।
  • প্লাস্টিকের প্যাকেজিং এড়িয়ে চলুন এবং স্থানীয় বাজার থেকে প্যাকেজিং ছাড়া পণ্য কিনুন।

২. গাছ লাগান এবং তাদের যত্ন নিন

  • প্রতি বছর অন্তত একটি গাছ অবশ্যই লাগান।
  • গাছ তাপমাত্রা কমায়, দূষণ পরিষ্কার করে এবং আমাদের অক্সিজেন দেয়।

৩. শক্তির সাশ্রয় করুন

  • কোঠা থেকে বের হওয়ার সময় লাইট এবং পাখা বন্ধ করুন।
  • যতটা সম্ভব সোলার এনার্জি ব্যবহার করুন।
  • গাড়ির পরিবর্তে সাইকেল বা গণপরিবহন ব্যবহার করুন।

৪. জল সাশ্রয় করুন

  • নল খোলা রাখবেন না।
  • বাথরুমে জলের অপচয় রোধ করুন।
  • বৃষ্টির জল সংগ্রহ (Rainwater Harvesting) করুন।

৫. পরিবেশ সম্পর্কে অন্যদের সচেতন করুন

  • শিশুদের প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা শেখান।
  • স্কুল, মহল্লা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পরিবেশ শিক্ষা ছড়িয়ে দিন।

ভারত এবং পৃথিবী দিবস

ভারতের মতো বড় এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশে পরিবেশগত সমস্যা আরও গুরুতর। বড় শহরগুলিতে বাতাসে দূষণ অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক গ্রামে পানির অভাব রয়েছে। আবর্জনার সঠিকভাবে নিষ্কাশন হচ্ছে না। কিন্তু ভালো দিক হল, ভারতে অনেক মানুষ, গ্রাম এবং সংস্থা রয়েছে যারা পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করছে। জৈব কৃষি, সৌরশক্তির ব্যবহার এবং প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের মতো বিষয়গুলি এখন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

স্কুল এবং কলেজের ভূমিকা

  • প্রতি বছর স্কুলগুলিতে পৃথিবী দিবসে পোস্টার প্রতিযোগিতা, চিত্রকর্ম, বক্তৃতা এবং গাছ লাগানোর মতো অনুষ্ঠান হয়। এর মাধ্যমে শিশুরা পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারে।
  • কিন্তু এটা জরুরি যে আমরা শুধুমাত্র একদিনের জন্য নয়, প্রতিদিন এই দায়িত্ব পালন করব।
  • ২২শে এপ্রিলের দিনটি আমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে – কি আমরা সত্যিই পৃথিবীর যত্ন নিচ্ছি? নাকি আমরা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থ চিন্তা করে একে ক্ষতি করছি?
  • পৃথিবী আমাদের সবকিছু দেয় – খাবার, পানি, বায়ু এবং বাসস্থান। এখন সময় এসেছে আমরাও কিছু ফিরিয়ে দেব।

তাই এই পৃথিবী দিবসে আমরা একটি ছোটো প্রতিজ্ঞা করি:

  1. একটি খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করুন (যেমন প্লাস্টিকের অত্যধিক ব্যবহার),
  2. এবং একটি ভালো অভ্যাস গ্রহণ করুন (যেমন গাছ লাগানো, পানি সাশ্রয় করা)।

Leave a comment