ভারতের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং বিপ্লবী সর্দার উধম সিং-এর জন্মবার্ষিকী ২৬শে ডিসেম্বর পালিত হয়। উধম সিং ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তাঁর জীবন বলিদান এবং বীরত্বের প্রতীক, বিশেষ করে জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার পর ব্রিটিশ কর্মকর্তা মাইকেল ও'ডায়ারকে প্রতিশোধ নেওয়ার কারণে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন।
জীবন পরিচয় এবং প্রারম্ভিক জীবন
উধম সিং ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অজেয় যোদ্ধা ও বিপ্লবী। ১৮৯৯ সালের ২৬শে ডিসেম্বর পাঞ্জাবের সাঙ্গরুর জেলার সুনম গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তিনি একটি কম্বোজ শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর জীবন কঠিন পরিস্থিতিতে শুরু হয়েছিল। তাঁর জীবনে প্রথম বড় আঘাত আসে যখন ১৯০১ সালে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয় এবং ১৯০৭ সালে তাঁর বাবাও মারা যান। এই দুটি ঘটনা উধম সিংকে সম্পূর্ণ একা করে দিয়েছিল।
অনাথ হয়ে যাওয়ার পর উধম সিং এবং তাঁর ভাই মুক্তাসিংকে অমৃতসরের একটি অনাথ আশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
এখানে থাকার সময় তাঁদের নাম পরিবর্তন করে উধম সিং এবং সাধু সিং রাখা হয়। উধম সিং-এর জীবনযাত্রায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক আসে যখন তিনি তাঁর নাম পরিবর্তন করে 'রাম মোহাম্মদ সিং আজাদ' রাখেন, যা তিনটি প্রধান ভারতীয় ধর্মের প্রতীক ছিল। এই পদক্ষেপটি ছিল তাঁর দ্বারা সর্বধর্ম সমভাবকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি ইঙ্গিত।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড এবং এর প্রভাব
উধম সিং-এর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল, যখন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। এই ঘটনা উধম সিং-এর আত্মাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ অফিসার জেনারেল ডায়ার নিরস্ত্র ভারতীয়দের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়, যার ফলে শত শত নিরীহ মানুষ মারা যায়। উধম সিং এই গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এবং এই ঘটনা তাঁর মনে প্রতিশোধের আগুন আরও তীব্র করে তোলে।
উধম সিং জালিয়ানওয়ালাবাগের মাটি হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি একদিন জেনারেল ডায়ারকে শাস্তি দেবেন। এই উদ্দেশ্য নিয়ে উধম সিং সারা বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি আফ্রিকা, ব্রাজিল, আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেন এবং তাঁর মিশন বাস্তবায়নের জন্য সবরকম প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
মাইকেল ও'ডায়ার হত্যা এবং উধম সিং-এর পরিকল্পনা
উধম সিং-এর লক্ষ্য ছিল মাইকেল ও'ডায়ারকে হত্যা করে ভারতীয়দের উপর ব্রিটিশ শাসনের নৃশংসতার প্রতিশোধ নেওয়া। ১৯৩৪ সালে উধম সিং লন্ডনে পৌঁছান এবং সেখানে একটি গাড়ি কেনেন, সেই সাথে ছয়-রাউন্ডের একটি রিভলভারও কিনেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ কর্মকর্তা মাইকেল ও'ডায়ারের বিরুদ্ধে সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
বহু বছর ধরে ধৈর্য সহকারে পরিকল্পনা করার পর, উধম সিং ১৯৪০ সালের ১৩ই মার্চ সেই সুযোগটি পান যখন রয়্যাল সেন্ট্রাল এশিয়ান সোসাইটির একটি সভায় মাইকেল ও'ডায়ার উপস্থিত ছিলেন। এই সভাটি লন্ডনের ক্যাক্সটন হলে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। উধম সিং সময়মতো সভাস্থলে পৌঁছে রিভলভারটি একটি মোটা বইয়ের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বইয়ের পাতাগুলো এমনভাবে কাটা হয়েছিল যাতে রিভলভারটি সহজেই তার মধ্যে ফিট হয়ে যায়।
মাইকেল ও'ডায়ারের হত্যা
সভার শেষে, উধম সিং দেওয়ালের পেছন থেকে হঠাৎ মাইকেল ও'ডায়ারের দিকে গুলি চালান। দুটি গুলি ও'ডায়ারের শরীরে লাগে এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর উধম সিং পালানোর চেষ্টা করেননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার হওয়ার জন্য নিজেকে সমর্পণ করেন।
উধম সিং-এর বিচার এবং ফাঁসি
উধম সিংকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁর বিচার শুরু হয়। ১৯৪০ সালের ৪ঠা জুন তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ১৯৪০ সালের ৩১শে জুলাই পেন্টনভিল জেলে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
উধম সিং-এর ঐতিহ্য এবং তাঁর অবদান
উধম সিং কেবল একজন সাহসী বিপ্লবী ছিলেন না, তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নায়কও ছিলেন, যিনি ভারতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। উধম সিং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভারতে আর কোনো স্থান নেই। তাঁর বীরত্ব ও আত্মত্যাগ শুধু ভারতীয়দের অনুপ্রাণিত করেনি, বরং তাঁর গল্প আজও প্রতিটি ভারতীয়ের হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলে।
ভারতে উধম সিং-এর মৃত্যুবার্ষিকী ৩১শে জুলাই পালিত হয় এবং তাঁর অবদান কখনোও ভোলা যাবে না। তাঁর স্মরণে উত্তরাখণ্ডের একটি জেলার নাম উধম সিং নগর রাখা হয়েছে, যা তাঁর বীরত্ব ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানায়।
উধম সিং-এর ঐতিহাসিক অবদান
উধম সিং যা কিছু করেছিলেন, তা কেবল একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রতিশোধের গল্প নয়, বরং এটি ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। তাঁর জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় যে, যদি কারও মনে সত্য নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম থাকে, তবে সে যেকোনো প্রতিকূলতার सामना করতে পারে এবং নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পারে।
আজ উধম সিং-এর গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের নিজেদের স্বাধীনতা এবং সম্মান রক্ষা করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। তাঁর বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ইতিহাস আমাদের সবসময় অনুপ্রাণিত করবে।