প্রতি মাসে আগমনী সংকষ্ট চতুর্থী ভক্তদের কাছে অত্যন্ত বিশেষ। এই ব্রত ভগবান গণেশকে উৎসর্গীকৃত, যিনি বিঘ্নহর্তা এবং সুখ-সমৃদ্ধির দেবতা হিসেবে পরিচিত। এই দিনে ব্রত রেখে এবং বিশেষ পূজনবিধি দিয়ে গণপতি বাপ্পার আরাধনা করলে জীবনের সংকট দূর হয় এবং মনোকামনা পূর্ণ হয়।
এই বার মে ২০২৫ সালে একদন্ত সংকষ্ট চতুর্থী এবং কালারাষ্ট্রীর যোগ অত্যন্ত শুভ এবং দুর্লভ। যদি আপনি এই দিনে ব্রত রাখার পরিকল্পনা করছেন বা গণেশ পূজার সংকল্প করছেন, তাহলে আসুন জেনে নেই সংকষ্ট চতুর্থীর তিথি, পূজনবিধি, শুভ মুহূর্ত এবং ভগবান গণেশকে কী কী অর্পণ করা উচিত।
সংকষ্ট চতুর্থী মে ২০২৫ তিথি ও চন্দ্রোদয় মুহূর্ত
সংকষ্ট চতুর্থীর ব্রত মে ২০২৫ সালে ১৬ মে, শুক্রবার রাখা হবে। পঞ্চাঙ্গ অনুযায়ী এই তিথি ১৬ মে সকাল ৪:০২ টায় শুরু হয়ে ১৭ মে সকাল ৫:১৩ টা পর্যন্ত থাকবে। উদয়তিথি অনুযায়ী ব্রত একই দিনে অর্থাৎ ১৬ মে রাখা হবে। এই দিনে ভগবান গণেশের বিশেষ পূজা করা হয় এবং ব্রতী চন্দ্রোদয়ের পর চন্দ্রমাকে অর্ঘ্য দিয়ে ব্রতের সমাপ্তি ঘটান। এই বার চন্দ্রোদয় রাত ১০:৩৯ টায় হবে। সংকষ্ট চতুর্থীকে সংকট দূরকারী তিথি মনে করা হয়, তাই এই দিনে গণেশজি-র কাছে পরিবারের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করা হয়।
সংকষ্ট চতুর্থী ব্রত ও পূজাবিধি:
স্নান এবং ব্রত সংকল্প করুন: এই দিনে সকালে তাড়াতাড়ি, অর্থাৎ ব্রহ্মমুহূর্তে উঠে স্নান করে পরিষ্কার পোশাক পরুন। এরপর ভগবান গণেশের মূর্তি বা ছবির সামনে বসে হাতে জল নিয়ে ব্রতের সংকল্প করুন।
সংকল্প মন্ত্র:
'হে গণপতি! আমি সংকষ্ট চতুর্থী ব্রত পালন করছি, দয়া করে আমার সকল কঠিনতা দূর করুন এবং সুখ-সমৃদ্ধি দান করুন।'
গণেশজির অভিষেক করুন: ভগবান গণেশের মূর্তি বা ছবিতে গঙ্গাজল বা পরিষ্কার জল দিয়ে স্নান করান। এতে পরিবেশ পরিষ্কার হয় এবং পূজার শুভ আরম্ভ হয়।
শৃঙ্গার এবং অর্পণ সামগ্রী চড়ান: ভগবান গণেশকে চন্দন, হলুদ এবং কুমকুম দিয়ে তিলক করুন।
তারপর ২১ গাঁট দূর্বা ঘাস, হলুদ বা লাল ফুল অর্পণ করুন, কারণ এই জিনিসগুলি গণেশজিকে খুব প্রিয়।
প্রসাদে মোদক, লাড্ডু বা গুড় দিয়ে তৈরি মিষ্টি চড়ান।
মন্ত্র জাপ করুন: পূজার সময় 'ॐ গং গণপতয়ে নমঃ' মন্ত্র কমপক্ষে ১০৮ বার জপ করুন। এই মন্ত্র সকল বিঘ্ন দূর করে এবং মনে শান্তি দেয়।
সংকষ্ট চতুর্থীর কথা পড়ুন বা শুনুন: পূজার পর একদন্ত সংকষ্ট চতুর্থীর পৌরাণিক কথা অবশ্যই পড়ুন বা শুনুন। এই কথা শোনার ফলে ব্রতের পূর্ণ ফল পাওয়া যায় এবং জীবনে আসা সংকট দূর হয়।
চন্দ্র দর্শন এবং অর্ঘ্য অর্পণ করুন: রাতে যখন চন্দ্রমা উঠে (এই বার রাত ১০:৩৯ টায়), তখন দুধ, জল এবং অক্ষত (চাল) মিশিয়ে চন্দ্রদেবকে অর্ঘ্য দিন।
প্রার্থনা করুন: 'হে চন্দ্রদেব! দয়া করে আমার দুঃখ দূর করুন এবং সুখ-সমৃদ্ধির আশীর্বাদ দান করুন।'
ব্রত পারণ করুন এবং দান দিন: চন্দ্রমাকে অর্ঘ্য দেওয়ার পর সাৎত্বিক ভোজন করে ব্রত ভাঙ্গুন।
এরপর গরিব এবং দরিদ্রদের অন্ন, বস্ত্র বা ধন দান করুন। এতে ভগবান গণেশ প্রসন্ন হন এবং জীবনে শুভ ফল পাওয়া যায়।
সংকষ্ট চতুর্থীতে ভগবান গণেশকে কী অর্পণ করবেন
সংকষ্ট চতুর্থীর ব্রত ভগবান গণেশকে উৎসর্গীকৃত। এই দিনে মানুষ গণপতি বাপ্পার পূজা করে নিজের জীবন থেকে দুঃখ ও সংকট দূর করার প্রার্থনা করে। যদি আপনি চান আপনার পূজা সম্পূর্ণ সফল হোক এবং ভগবান গণেশের বিশেষ কৃপা আপনার উপর বজায় থাকুক, তাহলে আপনাকে তাঁকে কিছু বিশেষ জিনিস অর্পণ করতে হবে।
- দূর্বা ঘাস – গণেশজির সবচেয়ে প্রিয় জিনিস: গণেশজিকে দূর্বা ঘাস খুব পছন্দ। পূজার সময় কমপক্ষে ২১ গাঁট দূর্বা তাঁকে অর্পণ করুন। দূর্বা তাজা হওয়া উচিত এবং তাতে তিন বা পাঁচটি পাতা অবশ্যই থাকতে হবে। বিশ্বাস করা হয় যে দূর্বা অর্পণ করলে বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হয় এবং কঠিন কাজও সহজে সম্পন্ন হয়।
- লাল এবং হলুদ ফুল – শুভতার প্রতীক: ভগবান গণেশকে লাল এবং হলুদ রঙের ফুল যেমন গোলাপ এবং গেন্ডা খুব প্রিয়। পূজায় এই ফুল ব্যবহার করুন। এই রং শক্তি, উর্জা এবং ইতিবাচকতার প্রতীক। এতে ভগবান গণেশ দ্রুত প্রসন্ন হন।
- মোদক এবং লাড্ডু – বাপ্পার মনপসন্দ ভোগ: গণেশজিকে মোদক খুব প্রিয়। যদি সম্ভব হয় তাহলে গুড় এবং নারকেল দিয়ে তৈরি সাধারণ মোদক তৈরি করুন অথবা বেসন এবং বুন্দির লাড্ডুও অর্পণ করতে পারেন। ঘরে তৈরি মিষ্টান্ন দিয়ে ভোগ দেওয়া বেশি শুভ হয়।
- জল ভরা কলস – পরিষ্কারতা এবং আস্থার প্রতীক: গণেশজির মূর্তির পাশে একটি তামা বা পিতলের কলস রাখুন যাতে পরিষ্কার জল ভরা থাকে। পূজার সময় এই জল দিয়ে গণেশজির অভিষেক করুন। এতে পরিবেশ পবিত্র হয় এবং মানসিক শান্তি পাওয়া যায়।
- ঘি-র দীপক এবং ধূপ – পূজার সমাপ্তি: পূজার শেষে ঘি-র দীপক জ্বালান এবং ভগবান গণেশের আরতি করুন। সাথে ধূপও জ্বালান, যাতে ঘরে সুগন্ধ ছড়ায় এবং নেতিবাচক শক্তি দূর হয়। আরতির সময় পবিত্র ভাব রাখুন এবং মনে প্রার্থনা করুন।
সংকষ্ট চতুর্থীতে দানের গুরুত্ব
সংকষ্ট চতুর্থীর দিন দান করা অত্যন্ত পুণ্যকর মনে করা হয়। এই দিনে যদি আপনি সাদা বস্ত্র, চাল, গুড়, মুগ, তিল এবং ঘি দান করেন, তাহলে এটি আপনার জীবনে ইতিবাচক শক্তি আনে। বিশেষ করে এই জিনিসগুলি রাহু এবং কেতু যেমন গ্রহের নেতিবাচক প্রভাব কমায়।
দান করার ফলে শুধু আপনার পাপের নাশ হয় না, বরং আপনার জীবনে সুখ-সমৃদ্ধিও আসে। দরিদ্রদের দান করলে মনে শান্তি পাওয়া যায় এবং ভগবান গণেশের কৃপাও বজায় থাকে। তাই সংকষ্ট চতুর্থীতে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী অবশ্যই দান করুন।
সংকষ্ট চতুর্থীর গুরুত্ব কী?
সংকষ্ট চতুর্থীর ব্রত ভগবান গণেশকে উৎসর্গীকৃত, যিনি "বিঘ্নহর্তা" অর্থাৎ সকল বাধা দূরকারী। এই দিনে ব্রত করে এবং গণেশজির পূজা করলে জীবনে চলমান সমস্যা যেমন কোর্ট-কাচারি কেস, পারিবারিক কলহ অথবা ব্যবসায়ে বাধা দূর হতে থাকে। এই ব্রত মানসিক শান্তি এবং আত্মবিশ্বাসও বাড়ায়, যার ফলে ব্যক্তি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
যারা কর্মজীবনে বাধা, সন্তান সুখে দেরি অথবা আর্থিক সংকটের মত সমস্যায় জর্জরিত, তাদের জন্য সংকষ্ট চতুর্থীর ব্রত অত্যন্ত ফলপ্রসূ মনে করা হয়। এই দিনে পূর্ণ শ্রদ্ধা ও নিয়ম দিয়ে ব্রত করলে ভগবান গণেশ প্রসন্ন হন এবং ভক্তের সকল মনোকামনা পূর্ণ করেন। তাই বলা হয় সংকষ্ট চতুর্থী শুধু ধার্মিক নয়, জীবন উন্নত করার আধ্যাত্মিক উপায়ও।
এই সংকষ্ট চতুর্থীতে পূর্ণ শ্রদ্ধাভরে ভগবান গণেশের পূজা করুন। নিয়মিতভাবে “ॐ গং গণপতয়ে নমঃ” মন্ত্র জপ করুন এবং দূর্বা অর্পণ করুন। সাথে দান-পুণ্য করুন যাতে আপনার সকল বাধা দূর হোক এবং জীবনে শান্তি-সফলতা বজায় থাকে।