ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনায় কাঁচা তেলের দামে ঊর্ধ্বগতি: ভারতের অর্থনীতি ও শেয়ার বাজারে প্রভাব

🎧 Listen in Audio
0:00

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা এবং তাতে আমেরিকার জড়িত থাকার ফলে কাঁচা তেলের (ক্রুড অয়েল) দামে তীব্র উত্থান-পতন দেখা যাচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে ভারতের মতো আমদানি-নির্ভর দেশগুলির অর্থনীতিতে এবং শেয়ার বাজারে।

২৩ জুন ২০২৫, ভারতীয় এবং বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারের জন্য সোমবার সকালে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা নিয়ে এসেছিল। ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে ইতিমধ্যেই চলমান উত্তেজনা আরও বেশি বিস্ফোরক হয়ে উঠেছে, যখন আমেরিকা স্পষ্টভাবে এই সংঘাতে হস্তক্ষেপ করেছে। পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার বোমা হামলা এবং ইরানের সতর্কবার্তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অস্থিরতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব তেলের দাম, বিশ্ব বাজার এবং বিনিয়োগকারীদের কৌশলগুলিতে দেখা যাচ্ছে।

যুদ্ধের মুখে দাঁড়িয়ে পশ্চিম এশিয়া

মধ্যপ্রাচ্য অর্থাৎ পশ্চিম এশিয়া সর্বদাই ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে। কিন্তু এখন আমেরিকা কর্তৃক ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তুলেছে। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ইরান যদি প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নেয়, তাহলে আমেরিকা আরও তীব্র সামরিক আক্রমণ চালাবে। এতে স্পষ্ট হয়েছে যে সংঘাত কেবল ইসরায়েল ও ইরান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি এখন একটি আন্তর্জাতিক সংকটের রূপ ধারণ করেছে।

শেয়ার বাজারে প্রভাব

এই ভূ-রাজনৈতিক সংকটের প্রথম প্রভাব ভারতীয় শেয়ার বাজারে স্পষ্ট দেখা গেছে। সোমবার ২৩ জুন বাজার খোলার সাথে সাথেই সেন্সেক্স এবং নিফটি উভয়ই নেমে গেছে। প্রাথমিক লেনদেনে সেন্সেক্স প্রায় ৭০০ পয়েন্ট পর্যন্ত নেমে গেছে, যখন নিফটি ১৮০ পয়েন্টের বেশি নেমে ২৫,০০০-এর নিচে চলে গেছে।

গত সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার বৃদ্ধি সত্ত্বেও ভারতীয় শেয়ার বাজারে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গিয়েছিল এবং সেন্সেক্স-নিফটিতে প্রায় দেড় শতাংশ বৃদ্ধি রেকর্ড করা হয়েছিল। কিন্তু আমেরিকার পদক্ষেপের পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে এবং তারা সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিচ্ছে।

কাঁচা তেলের দাম নতুন চ্যালেঞ্জ

এই সমগ্র ঘটনাক্রমের সবচেয়ে গুরুতর অর্থনৈতিক দিক হল কাঁচা তেলের দামের ঊর্ধ্বগতি। বর্তমানে কাঁচা তেলের দাম ৭৬ ডলার প্রতি ব্যারেলের উপরে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান যদি হরমুজ जलडमरूमध्य বন্ধ করে দেয়, তাহলে এই দাম ১৩০ ডলার প্রতি ব্যারেল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।

হরমুজ जलडमरूमध्य বিশ্বের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ, যার মাধ্যমে প্রায় ২০ শতাংশ বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহ হয়। এই পথের বাধাগ্রস্ত হওয়া কেবল তেলের দাম বাড়াবে না, বরং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য এবং শিপিং শিল্পকেও গুরুতরভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

বিনিয়োগকারীদের কৌশল পরিবর্তন

বর্তমানে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিকল্পের সন্ধান করছেন। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে সাধারণত বিনিয়োগকারীরা সোনা এবং আমেরিকান ডলারের মতো নিরাপদ সম্পদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। यही কারণে এই দুটিতে উর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিনিয়োগকারীদের এখন কাঁচা তেলের প্রবণতার উপর নজর রাখা উচিত এবং তার উপর ভিত্তি করে তাদের পোর্টফোলিও কৌশল তৈরি করা উচিত। উত্তেজনা আরও বাড়লে এটি বিনিয়োগের দিক সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করতে পারে।

মুদ্রাস্ফীতির উপর চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে

তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে ভারতের মতো আমদানি-নির্ভর দেশগুলির অর্থনীতিতে দ্বিগুণ প্রভাব পড়ে। একদিকে বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি পায় এবং অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির চাপও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই পরিস্থিতি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের আর্থিক নীতির প্রচেষ্টাকে উল্টে দিতে পারে।

যদি কাঁচা তেলের দাম দীর্ঘদিন ধরে উঁচুতে থাকে, তাহলে এর ফলে পরিবহন খরচ, ইনপুট খরচ এবং খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি মোট মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি করতে পারে, যা ইতিমধ্যেই আরবিআই-এর নজরদারিতে রয়েছে।

আমেরিকার কৌশল এবং বিশ্বব্যাপী সংকেত

বিশ্লেষকদের মতে, আমেরিকার এই হস্তক্ষেপ কেবল সামরিক নয়, বরং কৌশলগতও। পশ্চিম এশিয়ায় তার আধিপত্য শক্তিশালী করার এবং বিশ্বব্যাপী শক্তি বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য আমেরিকা কর্তৃক নেওয়া এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতে আরও ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।

এর প্রভাব কেবল ভারতের মতো উদীয়মান বাজারগুলিতে নয়, ইউরোপ, চীন এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির শক্তি নীতিও প্রভাবিত হতে পারে। বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের কৌশল এখন এই উত্তেজনার উপর ভিত্তি করেই তৈরি হবে।

ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং বিকল্প

ভারতের শক্তির চাহিদার বড় অংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ হয়। এই ক্ষেত্রে তেলের দাম বৃদ্ধি সরাসরি রাজস্ব ঘাটতি এবং বর্তমান হিসাব ঘাটতিতে প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়াও টাকার দুর্বলতার ফলে আমদানি আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে, যার ফলে ঘরোয়া বাজারে মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে।

সরকারের সামনে এখন দ্বৈত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একদিকে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং অন্যদিকে ভোক্তাদের মুদ্রাস্ফীতি থেকে মুক্তি দেওয়া। এই ক্ষেত্রে পেট্রোলিয়াম ভর্তুকির বিষয়েও সরকারকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।

Leave a comment