গৌতম আদানির নেতৃত্বাধীন আদানি গ্রুপের ইসরায়েলে ব্যাপক বিনিয়োগ বর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে এখন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
নয়াদিল্লি: বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ভারতের অন্যতম শিল্প গোষ্ঠী আদানি গ্রুপের সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে বর্ধমান সামরিক সংঘাতের মধ্যে আদানি গ্রুপের অর্থকোটি কোটি টাকার বিনিয়োগের উপর ঝুঁকির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আদানি পোর্টস এবং আদানি এন্টারপ্রাইজেসের শেয়ারের তীব্র অবনতি ইঙ্গিত করে যে বিনিয়োগকারীরা এই পরিস্থিতি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন।
শুক্রবার আদানি পোর্টসের শেয়ার ৩.২ শতাংশ নেমে ১৩৯৮ টাকায় বন্ধ হয়, অন্যদিকে আদানি এন্টারপ্রাইজেসের শেয়ার ২.৮ শতাংশ নেমে ২৪৬৯.৫৫ টাকায় নেমে আসে। এই অবনতি কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সংকেত নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আদানি গ্রুপের বিশ্বব্যাপী কৌশলের উপর যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে তারই এক ঝলক।
হাইফা পোর্টে ব্যাপক বিনিয়োগ, এখন ঝুঁকিতে
২০২৩ সালে আদানি গ্রুপ ইসরায়েলের কৌশলগত হাইফা পোর্টে প্রায় ৭০ শতাংশ অংশীদারিত্ব কিনেছিল। এই চুক্তির মূল্য প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার, যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এই পোর্ট ইসরায়েলের উত্তরে অবস্থিত এবং দেশের আমদানি-রপ্তানির একটি বড় অংশ এই বন্দর দিয়েই হয়।
যদিও বর্তমানে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সামরিক সংঘাত দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত, কিন্তু যদি এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে সমুদ্রপথের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। এর ফলে কেবলমাত্র মালবাহী ট্র্যাফিকই প্রভাবিত হবে না, বরং শিপিংয়ের খরচও বৃদ্ধি পাবে এবং সময়সীমার মধ্যে ডেলিভারি সম্ভব হবে না। এই পরিস্থিতি সরাসরি আদানি পোর্টসের ব্যবসায় প্রভাব ফেলতে পারে।
পূর্বেও চাপের মুখোমুখি হয়েছে
এটি প্রথমবার নয় যখন আদানি পোর্টসকে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার মূল্য দিতে হচ্ছে। পূর্বেও যখন এই অঞ্চলে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন আদানি পোর্টসের ড্রাই বাল্ক জাহাজগুলিকে পথ পরিবর্তন করতে হয়েছিল এবং অপারেশনে বাধা এসেছিল। এখন পরিস্থিতি আরও গুরুতর হতে দেখা যাচ্ছে।
প্রতিরক্ষা খাতে আদানির উপস্থিতি, দ্বিধাগ্রস্ত তরবারি
আদানি গ্রুপের ইসরায়েলে উপস্থিতি কেবলমাত্র পোর্ট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। ২০২৮ সালে গ্রুপটি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সংস্থা এলবিট সিস্টেমসের সাথে মিলিতভাবে আদানি এলবিট অ্যাডভান্সড সিস্টেমস ইন্ডিয়ার স্থাপনা করেছিল। এই যৌথ উদ্যোগ হায়দ্রাবাদে হার্মিস ৯০০ নামক ড্রোন তৈরি করে, যা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে।
এখন যখন ইসরায়েলকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের বেশি প্রয়োজন হতে পারে, এই যৌথ উদ্যোগের জন্য বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু একই সাথে, আদানির উপর আন্তর্জাতিক চাপও বৃদ্ধি পেতে পারে। যদি ইরান বা তার সহযোগী দেশগুলি এই অংশীদারিত্ব নিয়ে রাজনৈতিক অবস্থান নেয়, তাহলে আদানিকে বিশ্ব মঞ্চে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হতে পারে।
সেমিকন্ডাক্টর প্রকল্পে অস্থায়ী বিরতি
আদানি গ্রুপের ইসরায়েলে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা ছিল সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের। এই প্রকল্প ইসরায়েলের টাওয়ার সেমিকন্ডাক্টরের সাথে মিলিতভাবে শুরু হওয়ার কথা ছিল এবং এর ব্যয় প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ধরা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে এই প্রকল্প এখন স্থগিত হয়ে গেছে।
এই চুক্তি ভারতের জন্য প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতার দিকে একটি বড় ধাপ হতে পারত। কিন্তু বর্ধমান উত্তেজনা এবং বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার কারণে এই উদ্যোগ এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
বাজারে বর্ধমান অস্থিরতা
ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক ঘাঁটিতে ইসরায়েলের হামলার পর বিশ্ববাজারে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। কাঁচা তেলের দাম এক ঝটকায় ৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে এবং সোনার দামেও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে বিনিয়োগকারীরা বিশ্বব্যাপী এই উত্তেজনাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে এশিয়ান শেয়ার বাজারে তীব্র অবনতি দেখিয়েছে যে মধ্যপ্রাচ্যের আগুন পুরো বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগ পরিবেশকে প্রভাবিত করতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকির জালে আটকে ব্যবসায়িক স্বার্থ
আদানি গ্রুপের বিদেশ নীতি এবং বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের কৌশল এখন সরাসরি ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণের অধীন হচ্ছে। ইসরায়েলে ব্যবসায়িক উপস্থিতি আদানিকে একদিকে কৌশলগত লাভ দিয়েছে, অন্যদিকে বিনিয়োগ ঝুঁকিও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি এই যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়ে, অথবা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এতে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে আদানি গ্রুপের সুনাম এবং তার আন্তর্জাতিক প্রকল্প উভয়ই প্রভাবিত হতে পারে।
ভবিষ্যতের কৌশল নিয়ে সন্দেহ
আদানি গ্রুপের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তার বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগগুলি কীভাবে সুরক্ষিত রাখা যায় এবং ভবিষ্যতে এ ধরণের ঝুঁকির সাথে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত সরকার আদানি গ্রুপের মতো গোষ্ঠীগুলিকে বিদেশে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করেছিল, কিন্তু এখন সেই বিনিয়োগ নিয়ে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
কি ভারত সরকার কোন সহযোগিতা করবে?
এই পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নও উঠে আসে যে, ভারত সরকার কি আদানি গ্রুপের মতো বড় বিনিয়োগকারীদের ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার জন্য কোনো কৌশল তৈরি করছে। কি ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যিক চুক্তি আদানি গ্রুপকে ভবিষ্যতে কোনো সুবিধার দিকে নিয়ে যাবে, নাকি গ্রুপটিকে তার কৌশল পরিবর্তন করতে হবে।