উষা ভেন্সের ভারত ভ্রমণ বহু দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। এই ভ্রমণ কেবলমাত্র ভারত ও আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করতে সাহায্য করবে না, বরং বিশ্ব রাজনীতিতে উভয় দেশের অংশীদারিত্বকেও নতুন মাত্রা দিতে পারে।
নয়াদিল্লি: আমেরিকার উপ-রাষ্ট্রপতি জে.ডি. ভেন্স তাঁর চার দিনের ভারত ভ্রমণে রবিবার সকালে নয়াদিল্লি পৌঁছেছেন। তাঁর সাথে তাঁর স্ত্রী উষা ভেন্স এবং তিন সন্তান—ইভান, বিবেক এবং মিরাবেল—ও ভারতে এসেছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব পালম বিমানবন্দরে আমেরিকান প্রতিনিধিদলের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। তবে, এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এটি উষা ভেন্সের ভারতের প্রথম আনুষ্ঠানিক ভ্রমণ, যিনি ২০২৫ সালের জানুয়ারীতে তাঁর স্বামীর উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমবার ভারতে এসেছেন।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে উষা ভেন্সের এই ভ্রমণ কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক সফর নয়, বরং আবেগগত ও সাংস্কৃতিক যোগসূত্রের এক ঝলক। এই ভ্রমণ নিয়ে পর্যবেক্ষকদের আশা ভিন্ন ভিন্ন, কেউ কূটনৈতিক শক্তির আশা করছেন, আবার কেউ ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের বিশ্বব্যাপী সাফল্যের গর্ব অনুভব করছেন।
উষা ভেন্স: ভারতীয় শিকড়, আমেরিকান উড়ান
উষা ভেন্সের জন্ম ১৯৮৬ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের সান ডিয়েগোতে। তাঁর পিতামাতা অন্ধ্রপ্রদেশের বদ্দুরু গ্রাম থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন এবং তেলুগু ভাষী হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। তাঁর দাদা, রামশাস্ত্রী চিলুকুরী, ১৯৫৯ সালের দিকে আইআইটি মাদ্রাসে অধ্যাপনা করার জন্য চেন্নাই চলে গিয়েছিলেন। এই পটভূমি তাঁর পরিবারের শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে।
উষা ভেন্স ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেমব্রিজ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন এবং তিনি একজন প্রতিভাবান আইনজীবী ছিলেন। তিনি আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস এবং তৎকালীন ডিসি সার্কিট বিচারপতি ব্রেট কাভানাউয়ের জন্য ক্লার্কশিপ করেছেন। এর পর তিনি সান ফ্রান্সিসকোর খ্যাতনামা আইন সংস্থা "মুঙ্গার, টোলস অ্যান্ড ওলসন"-এ কাজ করছিলেন।
হিন্দু ধর্ম ও পারিবারিক সংস্কারের ছবি
উষা ভেন্স তাঁর ভারতীয় শিকড় এবং হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "আমি একটি ধর্মপ্রাণ পরিবারে বেড়ে উঠেছি। আমার পিতামাতা হিন্দু এবং এটাই একমাত্র জিনিস যা তাদের ভাল মানুষ এবং ভালো পিতামাতা করে তুলেছে। আমি ধর্মের সেই শক্তি দেখেছি।"
তাঁর এই বক্তব্য কেবল ধর্মীয় নিষ্ঠা প্রকাশ করে না, বরং এটিও বোঝায় যে কীভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং হিন্দু মূল্যবোধ তাঁর জীবনের সিদ্ধান্তগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২০১৪ সালে তিনি জে.ডি. ভেন্সের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যিনি ইয়েল ল স্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিলেন। এই বিবাহ হিন্দু এবং খ্রিস্টান উভয় রীতিনীতি অনুসারে সম্পন্ন হয়েছিল, যা উভয়ের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রকাশ করে।
পর্দার পিছনে কিন্তু প্রভাবশালী ভূমিকা
উষা ভেন্স জনসম্মুখে খুব কম দেখা যায় এবং মিডিয়া থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, তিনি তাঁর স্বামীর রাজনীতি ও সিদ্ধান্তে একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি কেবলমাত্র সমর্থনই করেননি, বরং রিপাবলিকান পার্টিতেও যোগদান করেন, যদিও আগে তিনি ডেমোক্র্যাট ছিলেন।
তাঁর সমালোচকরা যদিও তাঁর নীরবতার বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন, কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের মতে উষা একজন কৌশলী এবং ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তাশীল নারী, যিনি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং দিক নির্দেশনা দিতে পারদর্শী। তিনি তাঁর সন্তানদের লালন-পালনেও ভারতীয় সংস্কারকে গুরুত্ব দেন। তাঁর সন্তানদের নাম ইভান, বিবেক এবং মিরাবেলও তাঁদের সাংস্কৃতিক মিশ্রণকে প্রতিফলিত করে।
ভারত ভ্রমণ: একটি নতুন সূচনা
উষা ভেন্সের এই ভারত ভ্রমণ বহু দিক থেকে ঐতিহাসিক। এটি কেবলমাত্র আমেরিকা-ভারত সম্পর্ককে নতুন দিক দান করার মাধ্যম নয়, বরং ভারতীয়-আমেরিকান সম্প্রদায়ের জন্য এক অনুপ্রেরণাও। মনে করা হচ্ছে এই ভ্রমণের সময় উষা ভেন্স কেবলমাত্র দিল্লিই নয়, তাঁর পৈত্রিক গ্রাম বদ্দুরুতেও যেতে পারেন। এই ভ্রমণ আবেগগতভাবে তাঁর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে, বিশেষ করে যখন তিনি আমেরিকার প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত সেকেন্ড লেডি।
ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও এই ভ্রমণকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। কূটনৈতিক মহলে আশা করা হচ্ছে ট্রাম্প-ভেন্স প্রশাসন এবং প্রধানমন্ত্রী মোদীর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হবে, যেখানে ব্যবসা, প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা এবং শিক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু অন্যদিকে, উষা ভেন্সের ভারতের সাথে যোগসূত্র এই ভ্রমণকে ব্যক্তিগত ও আধ্যাত্মিক রঙও দিচ্ছে।
সম্প্রদায়ের জন্য গর্ব ও প্রশ্ন উভয়ই
একদিকে যদিও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ উষা ভেন্সের এই উচ্চতা অর্জনে গর্ব করছেন, অন্যদিকে কিছু দক্ষিণ এশীয় আমেরিকান সংগঠন তাঁর স্বামীর কট্টরপন্থী নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। অভিবাসন ও প্রজনন অধিকার নিয়ে ট্রাম্প-ভেন্স প্রশাসনের মতামত দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে।
তবুও, উষা ভেন্সের এই ভ্রমণ ভারতীয়-আমেরিকান নারীদের জন্য একটি অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ যে কীভাবে কেউ তাঁর সংস্কৃতি ও পরিচয় বজায় রেখে বিশ্ব মঞ্চে নেতৃত্ব দিতে পারেন।