ইন্দোরের রাজা রঘুবংশীর মেঘালয়ে হত্যাকাণ্ডে স্ত্রী সোনম ও ৪ যুবক গ্রেফতার। সোনমের প্রেমিক রাজ কুশওয়াহা ও ৩ বন্ধু টাকার লোভে ষড়যন্ত্র করেছিল।
রাজা হত্যা মামলা: ইন্দোরের রাজা রঘুবংশীর মেঘালয়ে হত্যাকাণ্ডে সমগ্র দেশ কেঁপে উঠেছে। এই ঘটনায় তার স্ত্রী সোনম রঘুবংশী এবং চার যুবককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। খবর, সোনম তার প্রেমিক রাজ কুশওয়াহার সাথে মিলে এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র করেছিল। বাকি তিন যুবককে টাকার লোভ দেখিয়ে এই ভয়াবহ পরিকল্পনায় জড়িত করা হয়েছিল। এই ঘটনা কোনও সিনেমার গল্পের মতো মনে হলেও এটি বাস্তবতা।
একটি হানিমুন, যা হয়ে উঠল হত্যা রহস্য
২০২৫ সালের ১১ই মে ইন্দোরে রাজা রঘুবংশী এবং সোনমের বিবাহ হয়। উভয় পরিবারের সম্মতিতে এই বিবাহের পর ২০শে মে এই নবদম্পতি হানিমুনের জন্য মেঘালয়ের শিলং যায়। কিন্তু যা আনন্দের মুহূর্ত হওয়ার কথা ছিল, তা পরিণত হলো ট্র্যাজেডিতে। ২৩শে মে রাজা ও সোনম শিলংয়ের কাছে সোহরা থেকে নিখোঁজ হয়। তাদের স্কুটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং ২রা জুন রাজার মৃতদেহ একটি গভীর খাদে পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে জানা যায়, তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
প্রথমে সোনমও নিখোঁজ ছিল এবং পরিবার তাকে খুঁজে পেতে সিবিআই তদন্তের দাবি করে। কিন্তু ৯ই জুন ঘটনা নতুন মোড় নেয়, যখন সোনম উত্তরপ্রদেশের গাজীপুরে একটি দোকানের সামনে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। মেঘালয় পুলিশ সোনমকে আটক করে এবং চারজন যুবককেও গ্রেফতার করে। পুলিশের দাবি, এই হত্যাকাণ্ড সোনম তার প্রেমিক ও তিনজন সুপারি কিলারের সাথে মিলে করেছে।
ষড়যন্ত্রের মাস্টারমাইন্ড: সোনম রঘুবংশী
পুলিশের মতে, সোনম এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান ষড়যন্ত্রকারী ছিল। সে তার স্বামী রাজাকে হানিমুনের প্রলোভনে মেঘালয়ে নিয়ে গিয়ে পরিকল্পিতভাবে তার হত্যা করে। মেঘালয়ের ডিজিপি আই. নোংরাং জানিয়েছেন, সোনম তার প্রেমিক রাজ কুশওয়াহার সাথে মিলে এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করেছে। বিবাহের আগেই সোনম এবং রাজ রাজার হত্যার পরিকল্পনা করেছিল।
সোনম ১৪ লক্ষ টাকায় তিনজন সুপারি কিলারকে ভাড়া করে এবং তাদের রাজার হত্যার জন্য প্রস্তুত করে। একটি চমকপ্রদ তথ্য হলো, যেদিন রাজার হত্যা হয়, সেদিন সোনম একাদশীর ব্রত রেখেছিল। পুলিশের মতে, যখন সুপারি কিলাররা পাহাড়ে উঠে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং হত্যার কাজ থেকে সরে আসতে চায়, তখন সোনম তাদের উপর চিৎকার করে বলে, "এটাকে মেরে ফেলতেই হবে, আমি ২০ লক্ষ টাকা দেব।" এ কথা শুনে খুনিরা রাজার উপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তার প্রাণ কেড়ে নেয়।
রাজ কুশওয়াহা: সোনমের প্রেমিক এবং ষড়যন্ত্রের দ্বিতীয় চরিত্র
রাজ কুশওয়াহা এই ঘটনার দ্বিতীয় বড় চরিত্র। সে মূলত উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা, কিন্তু কয়েক বছর আগে ইন্দোরে এসেছিল। প্রথমে সে গোবিন্দ নগরে ভাড়া বাড়িতে থাকত, কিন্তু পরে সোনমের বাবার প্লাইউড ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করে। সেখানেই তার সাথে সোনমের পরিচয় হয় এবং তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
পুলিশের মতে, সোনম ও রাজের প্রেমের সম্পর্ক এক বছরেরও কম সময়ের। রাজ, সোনমের চেয়ে প্রায় ৫ বছর ছোট। সোনম তার সাথে বিবাহ করতে চেয়েছিল, কিন্তু পরিবার তার বিবাহ রাজা রঘুবংশীর সাথে ঠিক করে। এর পর সোনম ও রাজ মিলে রাজাকে সরিয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র করে। রাজ তার তিন বন্ধুকে এই পরিকল্পনায় জড়িত করে এবং হত্যার দায়িত্ব নেয়।
বিশাল চৌহান: র্যাপিডো ড্রাইভার, যিনি সুপারি কিলার হয়ে উঠলেন
বিশাল চৌহান রাজ কুশওয়াহার পুরনো বন্ধু এবং একই মহল্লার বাসিন্দা। সে র্যাপিডো বাইক চালিয়ে তার পরিবারের খরচ চালাত। বিশাল একটি দরিদ্র পরিবার থেকে আসে এবং পুলিশ মনে করে সোনম এই সুযোগ নিয়েছে। সে বিশালকে রাজার হত্যার বিনিময়ে ১০ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখায়।
পুলিশের মতে, বিশাল টাকার লোভে এই ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছে। সে শিলংয়ে রাজা ও সোনমের সাথে ছিল এবং হত্যাকাণ্ডের সময় সেখানে উপস্থিত ছিল। বিশালকে মধ্যপ্রদেশ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সে এখন পুলিশের হেফাজতে রয়েছে।
আকাশ রাজপুত: বেকার যুবক, যিনি টাকার জন্য হত্যা করেছেন
আকাশ রাজপুত তৃতীয় আসামী, যে ইন্দোরের প্রান্তে থাকত। সে বেকার ছিল এবং রাজ কুশওয়াহার বন্ধু ছিল। আকাশও দরিদ্র পরিবার থেকে আসে এবং সোনম তাকেও টাকার লোভ দেখিয়ে ষড়যন্ত্রে জড়িত করে।
পুলিশ জানিয়েছে, আকাশকে হত্যার জন্য ১০ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সে শিলংয়ে হত্যাকাণ্ডের সময় উপস্থিত ছিল এবং রাজার উপর আঘাত করতে অংশ নিয়েছিল। আকাশকেও মধ্যপ্রদেশ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আনন্দ: চতুর্থ সুপারি কিলার
চতুর্থ আসামী আনন্দও সুপারি কিলার ছিল। তার সম্পর্কে এখনও তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি, কিন্তু পুলিশ জানিয়েছে, সেও রাজ কুশওয়াহার পরিচিত ছিল। সোনম তাকেও টাকার লোভ দেখিয়ে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত করে। আনন্দকে মধ্যপ্রদেশ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সে পুলিশের হেফাজতে রয়েছে।
কিভাবে খুলল ষড়যন্ত্রের পর্দা?
এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে মেঘালয় পুলিশ কয়েকটি সূত্র পেয়েছে। প্রথমত, একজন স্থানীয় পর্যটন গাইড অ্যালবার্ট পিডি জানিয়েছেন, ২৩শে মে রাজা ও সোনমের সাথে তিনজন অপরিচিত পুরুষও ছিল। এই সাক্ষ্য পুলিশের সন্দেহ আরও গভীর করে তোলে। এরপর, সোনমের কল রেকর্ড এবং সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের পর সোনম শিলং ছেড়ে গুয়াহাটি এবং পরে গাজীপুর যায়। ৮ই জুন রাতে সে তার পরিবারকে ফোন করে, এরপর পুলিশ তাকে গাজীপুরের একটি দোকান থেকে গ্রেফতার করে। মেঘালয় পুলিশ সোনমকে ৭২ ঘণ্টার ট্রানজিট রিমান্ডে নিয়েছে এবং চারজন আসামীর জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
ময়নাতদন্তের রিপোর্টের ভয়াবহ তথ্য
ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা যায়, রাজার হত্যা কতটা নির্মমভাবে করা হয়েছিল। খুনিরা গাছ কাটার ধারালো অস্ত্র দিয়ে রাজার উপর বহুবার আঘাত করে। তার মাথার ও পিঠে গভীর আঘাত ছিল, যার ফলে তার মৃত্যু হয়। পুলিশ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটিও উদ্ধার করেছে।