প্রতি বছর জুন মাসের ২৫ তারিখে বিশ্ব ভিটিলিগো দিবস পালিত হয়, যার উদ্দেশ্য হলো এই রোগ সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো দূর করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ভিটিলিগো, যা সাধারণত সাদা দাগ হিসেবে পরিচিত, একটি ত্বকের রোগ যেখানে শরীরের বিভিন্ন অংশে সাদা ছোপ বা দাগ দেখা যায়। এই রোগটি সংক্রামক নয়, তবে এর কারণে মানসিক এবং সামাজিক প্রভাব অনেক গভীর হতে পারে।
যদি ভিটিলিগো প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা যায়, তবে এর বিস্তার রোধ করা যেতে পারে এবং ত্বকের স্বাভাবিক রঙ অনেকাংশে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। চলুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক ভিটিলিগো কী, এর লক্ষণগুলো কী কী এবং কীভাবে সময় মতো চিকিৎসার মাধ্যমে এর প্রভাব কমানো যায়।
ভিটিলিগো কী?
ভিটিলিগো একটি অটোইমিউন স্কিন ডিসঅর্ডার। এক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে ত্বকের রঞ্জক কোষ (মেলানোসাইটস) -গুলোকে আক্রমণ করে, যার ফলে সেগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলস্বরূপ, শরীরের বিভিন্ন অংশের ত্বকে সাদা বা হালকা রঙের ছোপ দেখা যায়।
এই রোগটি:
- সংক্রমণের মাধ্যমে ছড়ায় না
- কোনো সংক্রমণ বা অ্যালার্জির কারণে হয় না
- যেকোনো বয়সে হতে পারে
- নারী এবং পুরুষ উভয়েরই সমানভাবে প্রভাবিত করে
ভিটিলিগোর প্রাথমিক লক্ষণ
সময়মতো ভিটিলিগো শনাক্ত করা গেলে এর বিস্তার রোধ করা যায় এবং চিকিৎসা ভালো ফল দিতে পারে। এর কিছু সাধারণ লক্ষণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- ত্বকে হালকা সাদা বা দুধের মতো রঙের ছোপ দেখা যাওয়া
- বিশেষ করে হাত, পায়ের আঙুল, ঠোঁটের চারপাশে, চোখের आसपास বা হাঁটুতে
- অহেতুকভাবে চুল সাদা হয়ে যাওয়া (মাথার ত্বক, ভ্রু বা দাড়িতে)
- ধীরে ধীরে ছোপগুলোর আকার বৃদ্ধি পাওয়া বা নতুন ছোপের উদ্ভব হওয়া
- আক্রান্ত স্থানে সহজে সানবার্ন হওয়া
যদি এই লক্ষণগুলোর মধ্যে কোনো একটি দেখা যায়, তবে একজন ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
চিকিৎসকদের মতামত কী?
আशियन হাসপাতালের ডঃ অমিতাভ ব্যানার্জি, যিনি ডার্মাটোলজি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর, বলেন: ‘ভিটিলিগোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রোগীরা যখন দাগগুলো বেশ ছড়িয়ে যায় তখন তারা ডাক্তারের কাছে আসেন। যদি প্রাথমিক লক্ষণগুলোর দিকে নজর দেওয়া যায়, তাহলে দাগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব এবং রঙ পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন যে, প্রাথমিক পর্যায়ে টপিক্যাল ক্রিম, ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট এবং ফটোথেরাপি-এর মতো বিকল্পগুলো বেশ কার্যকর।
সময় মতো চিকিৎসা কেন জরুরি?
1. রঙ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে
প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করলে ত্বকের স্বাভাবিক রঙ ধীরে ধীরে ফিরে আসতে পারে।
2. মানসিক চাপ থেকে সুরক্ষা
সাদা দাগ শুধু ত্বকের ওপর সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসকেও প্রভাবিত করে। সময় মতো চিকিৎসা নিলে ডিপ্রেশন এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
3. শিশুদের এবং তরুণদের আত্মবিশ্বাস
বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং তরুণরা এই পরিস্থিতিতে লজ্জিত হতে পারে। সঠিক তথ্য এবং চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের মানসিক বিকাশ সুরক্ষিত রাখা যায়।
4. বিস্তার রোধ করা যেতে পারে
ভিটিলিগো ধীরে ধীরে ছড়ায়। যদি এটিকে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করে চিকিৎসা শুরু করা যায়, তবে এর বিস্তার সীমিত করা সম্ভব।
ভিটিলিগোর চিকিৎসা – কী কী বিকল্প?
ভিটিলিগোর চিকিৎসা ব্যক্তিভেদে লক্ষণ, বয়স এবং ছোপের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে।
- টপিক্যাল চিকিৎসা: স্টেরয়েড ভিত্তিক ক্রিম এবং ক্যালসিনিউরিণ ইনহিবিটর যা রঙ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
- ফটোথেরাপি (NB-UVB): বিশেষ ধরনের UVB আলো ব্যবহার করে মেলানোসাইটগুলোকে পুনরায় সক্রিয় করা হয়।
- ওরাল মেডিকেশন এবং ভিটামিন সাপ্লিমেন্টস: ভিটামিন ডি, বি১২, ফোલિક অ্যাসিড-এর মতো সাপ্লিমেন্টগুলো ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে।
- সার্জিক্যাল বিকল্প: কিছু ক্ষেত্রে স্কিন গ্রাফটিং এবং মেলানোসাইট ট্রান্সপ্লান্ট-এর মতো পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
ভিটিলিগো থেকে কি সম্পূর্ণরূপে মুক্তি পাওয়া যায়?
সত্য হলো, ভিটিলিগোর এখনও পর্যন্ত কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই, তবে সময় মতো চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ভিটিলিগো জীবনভর স্থিতিশীল থাকতে পারে, আবার কারো ক্ষেত্রে এটি ধীরে ধীরে ছড়াতে পারে। এটি নির্ভর করে কত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা হয়েছে তার ওপর।
ভিটিলিগো কোনো ছুঁতিকর বা নিরাময়হীন রোগ নয়। এটি শুধুমাত্র ত্বকের রঙকে প্রভাবিত করে, তবে মানুষের আত্মবিশ্বাস, সামাজিক জীবন এবং মানসিক অবস্থাকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তাই, এই বিশ্ব ভিটিলিগো দিবসে আমরা সময়োপযোগী শনাক্তকরণ, সঠিক তথ্য এবং সংবেদনশীলতার সাথে এই রোগ মোকাবেলা করি।