কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সৃজনশীলতা ধ্বংসের আশঙ্কা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সৃজনশীলতা ধ্বংসের আশঙ্কা
সর্বশেষ আপডেট: 12-05-2025

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) কি মানুষের সৃজনশীল চিন্তাশক্তিকে ধ্বংস করছে? এই প্রশ্নটি আর কেবল কল্পনা নয়, বরং একটি গুরুতর উদ্বেগে পরিণত হয়েছে। AI যে গতিতে বিশ্বজুড়ে জায়গা করে নিয়েছে, তা আমাদের জীবনকে সহজ করে তুলেছে, কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে এখন গবেষকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ। Microsoft এবং Carnegie Mellon University-এর একটি নতুন গবেষণা এই দিকে চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করেছে।

AI-এর সুবিধা বৃদ্ধি, কিন্তু চিন্তাশক্তির হ্রাস

আজকাল ChatGPT এবং Google Gemini-র মতো AI টুলস কাজকে অনেক সহজ করে তুলেছে। ইমেইল লেখা হোক বা তথ্য খোঁজা হোক, মানুষ সরাসরি AI-এর সাহায্য নেয়। কিন্তু একটি নতুন গবেষণা বলে যে, যদি আমরা AI-এর উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হই, তাহলে আমাদের নিজের চিন্তা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দুর্বল হতে পারে। মানুষ এখন নিজে চিন্তা করার পরিবর্তে AI-এর উত্তরকেই সঠিক মনে করে। এর ফলে তাদের সৃজনশীলতা এবং মানসিক কর্মক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। AI উপকারী হলেও, প্রতিবার এর উপর নির্ভর করা আমাদের চিন্তাশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

৩১৯ জনের উপর সম্পাদিত গবেষণা: চমকপ্রদ তথ্য

Microsoft এবং Carnegie Mellon কর্তৃক সম্পাদিত এই গবেষণায় ৩১৯ জন এমন ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যারা সপ্তাহে অন্তত একবার জেনারেটিভ AI ব্যবহার করে। তাদের বিভিন্ন কাজ দেওয়া হয়েছিল, যেমন ইমেইল খসড়া তৈরি করা, প্রতিবেদন সম্পাদনা করা বা ডেটা চার্ট তৈরি করা।

যখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হলো যে তারা AI-এর উত্তর কতবার চ্যালেঞ্জ করে, তখন দেখা গেল যে ৬৪% মানুষ কোনো প্রশ্ন ছাড়াই AI-এর উত্তরকে সত্য মেনে নেয়। মাত্র ৩৬% মানুষ AI-এর পরামর্শের উপর চিন্তা করে, প্রশ্ন তোলে বা তাদের অভিজ্ঞতার সাথে তুলনা করে।

AI কি মানুষকে মানসিকভাবে নিস্তেজ করে তুলছে?

নতুন গবেষণার মতে, মানুষ AI-এর অভ্যাসে এতটাই ডুবে গেছে যে তারা আর নিজে চিন্তা করার চেষ্টা করে না। আগে যেখানে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে হতো, এখন মানুষ সরাসরি AI থেকে উত্তর পেয়ে নেয়। একে বিজ্ঞানীরা "মানসিক শর্টকাট" বলে থাকেন — অর্থাৎ চিন্তার পরিশ্রম থেকে বিরত থাকা। এর ফলে মানুষের চিন্তা, বিশ্লেষণ এবং নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এই পরিবর্তন আমাদের মানসিক সচেতনতাও দুর্বল করতে পারে। তাই প্রয়োজন এই যে আমরা AI ব্যবহার সাবধানতার সাথে করি, তার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে না পড়ি।

মানসিক নিস্তেজতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তির হ্রাস

AI-এর বর্ধিত সাহায্য মানুষের সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তিকে প্রভাবিত করেছে। আগে যখন আমরা কোন সিদ্ধান্ত নিতাম, তখন আমরা তথ্য যাচাই করতাম এবং আমাদের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে চিন্তা করতাম। এখন, মানুষ কোনো প্রশ্ন ছাড়াই AI-এর উত্তরকে সরাসরি মেনে নেয়। এর ফলে কেবল মানসিক নিস্তেজতা আসে না, বরং ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। তাই, প্রয়োজন এই যে আমরা AI ব্যবহার করি, কিন্তু একই সাথে নিজে চিন্তা করার অভ্যাসও বজায় রাখি। এর ফলে আমাদের চিন্তাশক্তি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা শক্তিশালী থাকবে।

প্রযুক্তির সুবিধা নিজের জায়গায়, কিন্তু ভারসাম্য প্রয়োজন

AI আমাদের কাজকে সহজ এবং দ্রুত করে তুলেছে, যার ফলে ব্যবসা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবায় উন্নতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু সম্পূর্ণরূপে AI-এর উপর নির্ভরশীল হওয়ার ফলে আমাদের চিন্তা এবং শেখার ক্ষমতার উপর প্রভাব পড়তে পারে। সৃজনশীলতা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এমন কিছু জিনিস যা AI থেকে শেখা যায় না। এগুলো আমাদের অভিজ্ঞতা, চিন্তা এবং বিশ্লেষণ থেকে আসে। যদি আমরা এই দক্ষতা হারাই, তাহলে AI-এর সাথেও আমাদের আসল মূল্য কমে যেতে পারে। তাই, AI ব্যবহার করার সময় ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন।

সমাধান কি হতে পারে?

AI-কে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা সমাধান নয়, বরং এর সুষম ব্যবহার প্রয়োজন। আমাদের AI-এর উত্তরের উপর প্রশ্ন তুলতে হবে, যেমন 'এটা কি সঠিক?' বা 'আমি কি এটাকে আরও ভালো করতে পারি?' এর ফলে আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়া বজায় থাকে। এছাড়াও, কিছু কাজে নিজে চিন্তা করা এবং তারপর AI-এর সাহায্য নেওয়া ভালো হবে। যেমন ইমেইল বা প্রতিবেদন লেখার সময় নিজেই শুরু করুন এবং তারপর AI-এর পরামর্শ নিন। এভাবে আমরা আমাদের সৃজনশীলতা বজায় রাখতে পারি এবং AI-এর সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারি।

AI একটি চমৎকার টুল, কিন্তু এটি মানুষের বিকল্প হতে পারে না। যদি আমরা এর উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ি, তাহলে আমরা নিজেরাই আমাদের মানসিক ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করছি। নতুন গবেষণা বলে যে, AI যতটা সাহায্যকারী, ততটাই বিপজ্জনকও হতে পারে।

Leave a comment