২০২৫: পুরীতে জগন্নাথ রথযাত্রা, ভক্তি ও আস্থার এক অপূর্ব মিলন

২০২৫: পুরীতে জগন্নাথ রথযাত্রা, ভক্তি ও আস্থার এক অপূর্ব মিলন
সর্বশেষ আপডেট: 5 ঘণ্টা আগে

পুরীর পবিত্র ভূমিতে আবারও শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং আস্থার এক অপূর্ব মিলন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। প্রতি বছরের মতো এবারও জগন্নাথ রথযাত্রা শুরু হতেই হাজার হাজার ভক্ত পুরীর দিকে ছুটে এসেছেন। ২০২৫ সালের জগন্নাথ রথযাত্রার সূচনা হয়েছে এক অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ এবং ভক্তিপূর্ণ পরিবেশে। ভগবান জগন্নাথ, তাঁর বড় ভাই বলভদ্র এবং বোন সুভদ্রা আজ নিজ নিজ রথে চড়ে পুরীর গুন্ডিচা মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছেন।

এই যাত্রা শুধু ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ নয়, এর সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আবেগপূর্ণ দিকও জড়িত। সবচেয়ে বিশেষ বিষয় হল, এই যাত্রাকালে ভগবান জগন্নাথ সাত দিন গুন্ডিচা মন্দিরে থাকেন। এই অবস্থান নিছক একটি প্রথা নয়, বরং এর পিছনে গভীর আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক বার্তা লুকানো আছে।

জমকালো রথযাত্রার সূচনা

রথযাত্রার শুভ মুহূর্ত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুরীর অলিতে-গলিতে কীর্তন ও শঙ্খধ্বণি বাজতে শুরু করে। হাজারো ভক্ত রথ টানার জন্য এসে জড়ো হন। সবাই একটিমাত্র অনুভূতি নিয়ে এসেছিলেন – ভগবানকে তাঁর নতুন আবাসে পৌঁছে দিতে তাঁরা যেন তাঁদের অবদান রাখতে পারেন। পুরীর প্রধান রাস্তা ফুল, আলপনা এবং পতাকায় সুসজ্জিত করা হয়েছে। পুরো শহর ভক্তির রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে।

গুন্ডিচা মন্দিরকে কেন মাসির বাড়ি বলা হয়

পুরীর প্রধান মন্দির থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গুন্ডিচা মন্দিরকে ভগবান জগন্নাথের মাসির বাড়ি হিসেবে গণ্য করা হয়। এমন বিশ্বাস রয়েছে যে, ভগবান প্রতি বছর তাঁর মাসির বাড়িতে সাত দিন কাটান। এই সময়ে তিনি তাঁর ভক্তদের আরও কাছে আসেন। যে ভক্তরা কোনো কারণে সারা বছর ভগবানের মূল মন্দিরে যেতে পারেন না, তাঁদের জন্য এই সময়টা আশীর্বাদের চেয়ে কম কিছু নয়।

গুন্ডিচা মন্দিরে থাকার প্রথা 

ভগবান জগন্নাথের গুন্ডিচা মন্দিরে সাত দিন থাকার বিষয়টি একটি প্রতীক। এটি দেখায় যে ভগবান কেবল তাঁর বিশাল মন্দিরে থাকেন না, বরং তিনি তাঁর ভক্তদের মাঝে এসে তাঁদের সুখ-দুঃখে অংশগ্রহণ করেন। রথযাত্রার এই পর্যায়ে ভগবান সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকেন, তাঁদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন এবং এই বার্তা দেন যে ঈশ্বর সকলের জন্য সহজলভ্য। এই অবস্থান ভক্তদের জন্য বিশেষ পুণ্যদায়ক বলে মনে করা হয়।

গুন্ডিচা মার্জনা: ভগবানের আগমনের প্রস্তুতি

রথযাত্রার এক দিন আগে গুন্ডিচা মন্দিরে বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়, যা গুন্ডিচা মার্জনা নামে পরিচিত। এই প্রথার অধীনে মন্দিরের প্রতিটি কোণা পরিষ্কার করা হয়, যাতে ভগবানের আগমন সম্পূর্ণ পবিত্রতা ও শুদ্ধতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। এই রীতি স্বয়ং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শুরু করেছিলেন, যা আজও পালন করা হয়। ভক্তরা এই দিনে মন দিয়ে পরিচ্ছন্নতার কাজে অংশ নেন এবং এটিকে একটি সেবা হিসেবে গণ্য করেন।

মন্দিরে অনুষ্ঠিত বিশেষ অনুষ্ঠান ও ভোগ

ভগবান জগন্নাথের গুন্ডিচা মন্দিরে অবস্থানের সময় সেখানে বিশেষ পূজা-অর্চনার আয়োজন করা হয়। প্রতিদিন নতুন ধরনের ভোগ নিবেদন করা হয়, যার মধ্যে ওড়িশার বিভিন্ন খাবারের বিশেষ স্থান রয়েছে। বিশেষ করে ডাল, মিষ্টি চাল, পিঠা, মউয়া এবং সাবুদানার खीर-এর মতো ঐতিহ্যবাহী খাবার ভগবানকে উৎসর্গ করা হয়। মন্দির ফুল, প্রদীপ এবং ঐতিহ্যবাহী সাজসজ্জার সামগ্রী দিয়ে সাজানো হয়, যা পরিবেশকে আরও মনোরম করে তোলে।

ভক্তদের জন্য এক বিশেষ অভিজ্ঞতা

এই সাত দিন গুন্ডিচা মন্দিরের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভক্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সারা দেশ থেকে আগত দর্শনার্থীরা এখানে দর্শনের জন্য দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করেন। কেউ भजन গান করেন, কেউ ভগবানের সেবা করেন, আবার কেউ মন্দিরের সাজসজ্জায় ব্যস্ত থাকেন। এই সময় মন্দির প্রাঙ্গণে এক প্রকার দিব্যতা অনুভূত হয়, যা ভক্তদের মনে শান্তি ও আনন্দ দেয়।

বহুদা যাত্রা: প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি

সাত দিন পর ভগবান জগন্নাথ তাঁর মাসির বাড়ি থেকে মূল মন্দিরে ফিরে আসেন। এই প্রত্যাবর্তনের যাত্রা বহুদা যাত্রা নামে পরিচিত। এই দিনে আবারও তিনটি রথ ভক্তদের দ্বারা টানা হয় এবং পুরো পুরী নগরী আবারও জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়। এই যাত্রা প্রথম যাত্রার মতোই জাঁকজমকপূর্ণ ও আনন্দময় হয়।

ভগবান জগন্নাথের এই বিশেষ রূপ

রথযাত্রার সময় ভগবান জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা তাঁদের চিরাচরিত রূপ থেকে কিছুটা ভিন্ন রূপে ভক্তদের সামনে আসেন। কাঠ দিয়ে তৈরি এই বিশাল রথগুলিতে আসীন তিন ভাইবোনের এক ঝলক দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন আসেন। অনেক ভক্ত তো এই রথগুলির দড়ি স্পর্শ করতে পারাকেও তাঁদের জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য বলে মনে করেন।

পুরীতে আস্থার সাগর

পুরী এই মুহূর্তে সম্পূর্ণরূপে ভক্তদের রঙে রাঙানো। রেলস্টেশন থেকে শুরু করে মন্দিরের কাছাকাছি পর্যন্ত সর্বত্র ভক্তি, সেবা এবং প্রেমের এক অসাধারণ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারাও বাইরে থেকে আসা যাত্রীদের স্বাগত জানাতে কোনো কসরত করছেন না। রথযাত্রা আবারও প্রমাণ করেছে যে ভগবান জগন্নাথের প্রতি ভক্তদের আস্থা প্রতি বছর নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়।

 

Leave a comment