দেশে তৈরি নতুন গাড়ির পরিবহণ পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে। এখন আগের তুলনায় সড়কপথের পরিবর্তে রেলপথে বেশি গাড়ি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানো হচ্ছে।
নতুন দিল্লি: ভারতীয় রেলপথ গত এক দশকে যে পরিবর্তনগুলি এনেছে, তা কেবলমাত্র দেশীয় পরিবহণ ব্যবস্থাকে নতুন দিক দিয়েছে তাই নয়, বিশ্বব্যাপী ভারতের সুনামকেও শক্তিশালী করেছে। বিশেষ করে নতুন তৈরি গাড়ির পরিবহণের ক্ষেত্রে ভারতীয় রেলপথ এমন একটি কাজ করে দেখিয়েছে যা চীন ও জার্মানির মতো দেশও পিছিয়ে রয়েছে। আজ ভারত, আমেরিকার পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে যা রেলের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি গাড়ি পরিবহণ করে।
এক দশকে ঘটেছে ঐতিহাসিক পরিবর্তন
২০১৩-১৪ সালের কথা যদি বলি, তখন ভারতে তৈরি গাড়ির মাত্র ১.৫% গাড়িই রেলের মাধ্যমে পাঠানো হত। সড়কপথই ছিল প্রধান মাধ্যম। কিন্তু রেলের অবিরাম প্রচেষ্টা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে আজ এই সংখ্যা ২৪% এরও বেশি হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি চারটি গাড়ির মধ্যে একটি এখন রেলযোগে পাঠানো হয়। ২০২৪-২৫ সালে এই সংখ্যা প্রায় ১২.৫ লক্ষ গাড়িতে পৌঁছেছে, যেখানে ভারতে মোট ৫০.৬ লক্ষ গাড়ি তৈরি হয়েছে।
কেন এল এই পরিবর্তন
এই পরিবর্তনের পিছনে অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল রেল পরিবহণের সুবিধাজনক, সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব হওয়া। গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলিকে রেলের এই ব্যবস্থা এত পছন্দ হয়েছে যে তারা নিজেরাই এখন রেলের মাধ্যমে গাড়ি পাঠানোর ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
রেলও এ ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করেনি। ২০০৩-১৪ সালে যেখানে মাত্র ১০ টি র্যাক গাড়ি পরিবহণের জন্য ছিল, সেখানে ২০২৪-২৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ১৭০ টি র্যাকে পৌঁছেছে। এছাড়াও রেলপথ ২০২৪-২৫ সালে মোট ৭৫৭৮ রাউন্ড (চক্কর) গাড়ি র্যাক পরিবহণের জন্য চালিয়েছে, যা এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেকর্ড।
আমেরিকার পর ভারত, চীন-জার্মানিও পিছনে
বিশ্বের মানচিত্রে নজর দিলে দেখা যাবে, এখন কেবল আমেরিকাই এমন একটি দেশ যা ভারতের চেয়ে বেশি গাড়ি রেলযোগে পাঠায়। আমেরিকায় প্রতি বছর প্রায় ৭৫ লক্ষ গাড়ি রেলের মাধ্যমে পরিবহণ করা হয়। ভারতের এই সংখ্যা ১২.৫ লক্ষে পৌঁছেছে, যখন জার্মানি এই ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে রয়েছে, যেখানে মাত্র ৬ লক্ষ গাড়ি রেলপথে পরিবহণ করা হয়। চীনের মতো বৃহৎ দেশও এই ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে।
প্রযুক্তি ও নকশায় উন্নয়ন
ভারতীয় রেল কেবলমাত্র র্যাকের সংখ্যা বৃদ্ধি করেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, বরং গাড়ি পরিবহণকারী ভ্যাগনের নকশায়ও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে একটি র্যাকে ২৭ টি ভ্যাগন থাকত এবং তাতে মাত্র ১৩৫ টি SUV গাড়িই তোলা যেত। কিন্তু এখন এগুলিকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে একবারে ২৭০ টি SUV পর্যন্ত নেওয়া যায়।
ডাবল ডেকার ভ্যাগনে বড় আকারের SUV গুলিকেও সহজেই লোড ও আনলোড করা যায়। এতে কোম্পানিগুলিকে কেবলমাত্র বেশি গাড়ি পাঠানোর সুবিধা মিলেছে তাই নয়, সময় ও ব্যয়ের দিক থেকেও ব্যাপক সাশ্রয় হয়েছে।
সড়ক পরিবহণে ধাক্কা
রেল পরিবহণের বর্ধমান চাহিদার ফলে সড়ক পরিবহণের উপর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে ট্রাক অপারেটর ও লজিস্টিক কোম্পানিগুলিকে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। একটি প্রতিবেদনের মতে, আগে ৬০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে যাওয়া গাড়িগুলি বেশিরভাগ ট্রাকের মাধ্যমে পাঠানো হত, কিন্তু এখন তাদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে।
যদিও এই পরিবর্তন লজিস্টিক সেক্টরের কিছু অংশের জন্য নেতিবাচক হতে পারে, তবে ব্যাপক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এতে দেশের অনেক সুবিধা হয়েছে।
পরিবেশের জন্য স্বস্তি
ট্রাকের তুলনায় ট্রেন অনেক কম কার্বন নিঃসরণ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যত গাড়ি এখন রেলের মাধ্যমে পাঠানো হয়, তাতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লিটার ডিজেল সাশ্রয় হচ্ছে এবং হাজার হাজার টন কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ বন্ধ হচ্ছে। এটি ভারতের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি পূরণের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
গাড়ি কোম্পানিগুলির পছন্দ হয়ে উঠেছে রেল
দেশের প্রধান গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলি যেমন মারুতি সুজুকি, হুন্ডাই, টাটা মোটরস, মহীন্দ্রা অ্যান্ড মহীন্দ্রা ইত্যাদি এখন রেলকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তাদের মতে রেলের সেবা এখন আগের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য, সময়োপযোগী এবং সাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। অনেক কোম্পানি রেলের সাথে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিও করেছে।
মারুতি সুজুকি, যা দেশের বৃহত্তম গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি, ইতিমধ্যেই বার্ষিক লক্ষ লক্ষ গাড়ি রেলের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে। কোম্পানির দাবি, এতে তাদের লজিস্টিক খরচে ২০ থেকে ২৫% পর্যন্ত সাশ্রয় হয়।