অফিসে কাজের গতি বাড়াতে ChatGPT, Google Gemini অথবা Microsoft Copilot-এর মতো AI টুল ব্যবহার করছেন? যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে এই খবর আপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, AI ব্যবহারকারী কর্মীদের তাঁদের সহকর্মীরা ‘মেধাবী’ অথবা ‘দক্ষ’ না বলে ‘আলস্যবান’ ও ‘অযোগ্য’ মনে করেন। অর্থাৎ, যে প্রযুক্তি আপনাকে দক্ষ করে তুলছে, সেটিই আপনার কর্মজীবনে একটি নতুন সামাজিক ঝুঁকি হিসেবেও দেখা দিতে পারে।
AI দিয়ে স্মার্ট কাজ না ‘আলস্যবান’ এর পরিচয়?
আজকাল অফিসে কাজ করার পদ্ধতি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। অনেকেই এখন রিপোর্ট তৈরি করা, ইমেইল লেখা, ডাটা অ্যানালাইসিস করা অথবা কোডিংয়ের মতো কাজ AI টুলের সাহায্যে করছেন। ChatGPT, Google Gemini এবং Copilot-এর মতো টুল এখন খুব সাধারণ হয়ে উঠেছে। এই টুলগুলো কাজকে অবশ্যই দ্রুত ও সহজ করে তোলে, যার ফলে সময় সাশ্রয় হয় এবং উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই সুবিধার সাথে সাথে একটি নতুন চ্যালেঞ্জও দেখা দিচ্ছে।
ডুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নতুন গবেষণায় চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা অনুসারে, অফিসে যখন কেউ AI-এর অতিরিক্ত ব্যবহার করে, তখন তার সহকর্মীরা তাকে তেমন মেধাবী অথবা দক্ষ মনে করেন না। বরং তাদের মনে হয় যে ব্যক্তিটি কাজ এড়াচ্ছে অথবা নিজের দক্ষতার উপর আস্থা রাখে না। অর্থাৎ, প্রযুক্তি আপনাকে সাহায্য করছে, কিন্তু একই সাথে আপনার চিত্রের উপরও প্রভাব ফেলছে।
গবেষণায় কী উদ্ঘাটন হয়েছে?
এই গবেষণাটি আমেরিকায় করা হয়েছে, যেখানে ৪,৪০০ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই গবেষণাকে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার ব্যাপারে বোঝা গেছে।
প্রথম পরীক্ষা: দৃষ্টিতে পতন
এই পর্যায়ে অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, যদি কোনো সহকর্মী AI ব্যবহার করে প্রজেক্ট সম্পন্ন করে, তাহলে তারা তাকে কেমন দেখবে? চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ লোক মনে করেছিলেন যে এমন ব্যক্তিকে ‘কম মেধাবী’, ‘কাজ এড়ানো’ এবং ‘কম আত্মনির্ভরশীল’ মনে করা হবে। কেউ কেউ এটাও বলেছিলেন যে এমন কর্মীকে সহজেই বদল করা যেতে পারে কারণ তার আসল দক্ষতার ধারণা পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয় পরীক্ষা: AI ব্যবহারকারীকে নির্ভরশীল ও অসহায় বলে চিহ্নিত করা
দ্বিতীয় পর্যায়ে লোকেদের বলা হয়েছিল যে তারা AI ব্যবহারকারী সহকর্মীদের বর্ণনা করুক। উত্তরে তাদের ‘অসহায়’, ‘কম আত্মবিশ্বাসী’ এবং ‘নির্ভরশীল’ এর মতো ট্যাগ পাওয়া গেছে। এটি বোঝায় যে, AI যতই সহায়ক হোক না কেন, লোকের দৃষ্টিতে এই সাহায্য একটি দুর্বলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তৃতীয় পরীক্ষা: চাকরি পাওয়ার পথে বাধা
তৃতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণকারীদের হায়ারিং ম্যানেজারের ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে তারা এমন প্রার্থী নির্বাচন করুক যারা কোনো কোম্পানির জন্য উপযুক্ত। দেখা গেছে যে, যারা AI টুল খোলাখুলি ব্যবহার করতেন, তাদের নিয়োগের সম্ভাবনা কম ছিল। কিন্তু একটি আকর্ষণীয় মোড় তখন এসেছে যখন হায়ারিং ম্যানেজার নিজেই AI ব্যবহার করতেন—তখন তার কোনো পার্থক্য ছিল না যে প্রার্থী AI ব্যবহার করে অথবা করে না।
চতুর্থ পর্যায়: প্রযুক্তি দিয়ে কার্যকর কাজ
এই পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, যদি AI ব্যবহার কোনো কাজে স্পষ্টতই পারফরম্যান্স উন্নত করে, তাহলে সহকর্মীদের নেতিবাচক চিন্তাধারা অনেকাংশে কমে যায়। অর্থাৎ, যদি AI-এর ব্যবহার সবার সামনে স্পষ্ট থাকে, তাহলে মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তিত হতে পারে।
AI-এর বর্ধমান প্রভাব: সুবিধা এবং সামাজিক ক্ষতি
আজকাল অফিসে AI-এর ব্যবহার খুবই সাধারণ হয়ে উঠছে। লোকেরা ইমেইলের উত্তর দেওয়া, রিপোর্ট তৈরি করা, ডাটা অ্যানালাইসিস করা এবং প্রেজেন্টেশন তৈরির মতো অনেক কাজে AI টুলের সাহায্য নেন। এর ফলে কাজ দ্রুত ও সহজে সম্পন্ন হয়, যার ফলে সময় ও পরিশ্রম উভয়ই সাশ্রয় হয়। AI-এর সাথে জড়িত এই সুবিধাগুলো কর্মীদের কাজের গতিকে বাড়াচ্ছে, কিন্তু এর আরেকটি দিকও আছে যা উপেক্ষা করা যাবে না।
ডুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা এই দিকটির ইঙ্গিত দেয় যে, সমাজ এখনও AI দিয়ে করা কাজকে তেমন গুরুত্ব দেয় না যতটা মানুষ দ্বারা নিজে করা কাজকে। অর্থাৎ, যদি কোনো কর্মী AI-এর সাহায্য নিয়ে ভালো কাজ করে, তবুও তাকে মেধাবী ও দক্ষ বলে মনে করা হয় না। বরং লোকেরা তাকে ‘কম মেধাবী’ অথবা ‘আলস্যবান’ বলে মনে করতে পারে। এই চিন্তাধারার সরাসরি প্রভাব তার আত্মবিশ্বাস এবং পেশাদার চিত্রের উপর পড়তে পারে। এটাই কারণ যে, AI যতই আপনার জন্য উপকারী হোক না কেন, তাকে কখন এবং কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।
AI ব্যবহার করা কি ভুল?
AI ব্যবহার করা সম্পূর্ণ ভুল নয়। প্রযুক্তির উদ্দেশ্য সবসময় মানুষকে সাহায্য করা এবং তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। AIও এই দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র যা কাজকে সহজ ও দ্রুত করতে পারে। কিন্তু জরুরি হলো AI-কে সহায়ক হিসেবে ধরা উচিত, বিকল্প হিসেবে নয়। অর্থাৎ, AI আপনার জায়গায় কাজ করার জন্য নয় বরং আপনার সাহায্য করার জন্য। কর্মীদের উচিত তাদের সহকর্মী ও ম্যানেজারদের স্পষ্ট করে জানানো যে তারা তাদের কাজকে উন্নত ও কার্যকর করার জন্য AI ব্যবহার করছেন, কাজ এড়ানোর অথবা আলস্য দেখানোর জন্য নয়। এর ফলে অফিসে AI-এর প্রতি ভুল বোঝাবুঝি কমবে এবং আপনার পরিশ্রমের সঠিক স্বীকৃতি পাওয়া যাবে।
চিন্তাধারা পরিবর্তন করতে হবে
আজ AI শুধুমাত্র প্রযুক্তিবিদদের কাছে সীমাবদ্ধ নেই, বরং সাধারণ কর্মীদের মধ্যেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এই কারণে কাজ করার পদ্ধতির সাথে সাথে আমাদের চিন্তা করার পদ্ধতিও পরিবর্তন করা জরুরি। লোকেদের বুঝতে হবে যে AI ব্যবহার কোনো আলস্য অথবা দুর্বলতা নয়, বরং কাজকে উন্নত ও দ্রুত করার মাধ্যম। যতক্ষণ না এই চিন্তাধারা সমাজ ও অফিসের পরিবেশে আসবে, ততক্ষণ AI-কে খোলাখুলি ও নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা কঠিন হবে। তাই আমাদের ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন গ্রহণ করতে হবে এবং একই সাথে আমাদের আশেপাশের লোকেদের কাছেও এর সুবিধা ব্যাখ্যা করতে হবে যাতে সবাই মিলে একটি নতুন, ইতিবাচক চিন্তাধারা তৈরি করতে পারে।
প্রযুক্তির সাথে ভারসাম্য জরুরি
প্রযুক্তির সাথে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। AI ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা ঠিক হবে না, কারণ এর ফলে কাজের গতি এবং গুণগত মান উভয়ই উন্নত হতে পারে। কিন্তু এই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে যে AI কীভাবে এবং কখন ব্যবহার করা হচ্ছে। যদি কোনো কর্মী প্রতিটি কাজ শুধু AI-এর উপর ছেড়ে দেয় এবং নিজে নতুন দক্ষতা অর্জন করা অথবা পরিশ্রম করার ব্যাপারে দূরে সরে থাকে, তাহলে তার চিত্রের উপর প্রভাব পড়তে পারে। অন্যদিকে, যারা AI-কে তাদের সাহায্য হিসেবে ব্যবহার করে এবং নিজেরাও পরিশ্রম করে, তাদের অবদান কম মূল্যায়ন করা উচিত নয়। তাই AI এবং নিজের প্রচেষ্টার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখাই সাফল্যের চাবিকাঠি।
এই গবেষণা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, প্রযুক্তি দিয়ে কাজের গতি বৃদ্ধি করা সম্ভব, কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি তেমন দ্রুত পরিবর্তিত হয় না। যতক্ষণ না অফিস কালচারে AI-কে একটি ইতিবাচক সম্পদ হিসেবে দেখা হবে, ততক্ষণ এর ব্যবহার নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে। তাই জরুরি যে কর্মীরা শুধুমাত্র AI-এর বুদ্ধিমানের মতো ব্যবহার না করে, বরং তাদের সহকর্মীদের সাথে এ ব্যাপারে খোলাখুলি আলোচনাও করুক। একই সাথে, কোম্পানিগুলোকেও উচিত AI ব্যবহারকারীদের লেবেল দেওয়ার পরিবর্তে তাদের দক্ষতা ও আউটপুটের দিকে নজর দেওয়া।