বর্তমান বিশ্বব্যাপী সুরক্ষা পরিস্থিতিতে মহাকাশের ভূমিকা কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষাপটেই চীন একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার অধীনে ২০,০০০-এরও বেশি উপগ্রহ মহাকাশে পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
নয়াদিল্লি: বর্তমান বিশ্বব্যাপী সুরক্ষা পরিস্থিতিতে মহাকাশের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় চীন একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অধীনে ২০,০০০-এরও বেশি উপগ্রহ মহাকাশে পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে, যা মূলত গুপ্তচরবৃত্তি ও নজরদারির উদ্দেশ্যে কাজ করবে। এই পদক্ষেপ ভারতসহ অনেক দেশের জন্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে।
চীনের এই উচ্চাভিলাষী উপগ্রহ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মহাকাশে তার দখল আরও বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে সে বিশ্বব্যাপী ও আঞ্চলিক কৌশলগুলিতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারবে। অন্যদিকে, ভারতও তার নিরাপত্তা ও সতর্কতা বজায় রাখার জন্য উপগ্রহ ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে প্রস্তুতি নিচ্ছে যাতে কোনও সম্ভাব্য বিপদের মোকাবেলা করা যায়।
চীনের ২০,০০০ উপগ্রহের উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপ
চীনের পরিকল্পনা হলো নিম্ন কক্ষপথে (Low Earth Orbit) ২০,০০০-এরও বেশি ছোট ও বড় উপগ্রহ স্থাপন করা। এই উপগ্রহগুলি গুপ্তচরবৃত্তির পাশাপাশি যোগাযোগ, নেভিগেশন ও পরিবেশগত পর্যবেক্ষণের মতো কাজও করবে, তবে মূল ফোকাস থাকবে সামরিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের উপর। এই উপগ্রহগুলির মাধ্যমে চীন:
- শত্রুর সামরিক কার্যকলাপের নজরদারি করবে।
- রেডিও, মোবাইল ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক সংকেত ট্র্যাক করবে।
- সিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডার (SAR) প্রযুক্তির মাধ্যমে যেকোনো আবহাওয়া বা রাতের বেলায়ও স্পষ্ট ছবি তুলবে।
- যেকোনো এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনার তাৎক্ষণিক খবর পাবে।
- এর অর্থ হল চীন মহাকাশ থেকে প্রতিটি কার্যকলাপের উপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখতে পারবে, যার ফলে তার গুপ্তচরবৃত্তি ক্ষমতা অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে।
স্যাটেলাইট গুপ্তচরবৃত্তি কীভাবে কাজ করে?
স্যাটেলাইট ইন্টেলিজেন্স তিনটি প্রধান উপায়ে কাজ করে:
- ইমেজারি ইন্টেলিজেন্স (IMINT): উচ্চমানের ছবি ও ভিডিও তুলে শত্রুর সামরিক ঘাঁটি, অস্ত্র ও কার্যকলাপের সন্ধান পাওয়া।
- সিগনাল ইন্টেলিজেন্স (SIGINT): রেডিও, মোবাইল ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ট্র্যাক করে ডিকোড করা। এটি সন্ত্রাসবাদ ও আক্রমণের আগাম সতর্কতা দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর।
- রাডার ইন্টেলিজেন্স: সিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডার প্রযুক্তির মাধ্যমে মেঘ বা অন্ধকারেও স্পষ্ট ছবি তোলা। এতে ক্রমাগত নজরদারি নিশ্চিত হয়।
এই পদ্ধতিগুলিতে প্রাপ্ত তথ্য সামরিক কৌশল, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের সতর্কতা ও প্রস্তুতি
ভারতও মহাকাশ নিরাপত্তা ও নজরদারির ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ভারত সরকার ও ISRO, DRDO, RAW, এবং NTRO-র মতো প্রধান প্রতিষ্ঠান মিলে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছে। গত কয়েক বছরে ভারত অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে, যা:
- সীমান্তে সন্দেহজনক কার্যকলাপের ক্রমাগত নজরদারি করে।
- সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি ও অনুপ্রবেশের হুমকির সময়োচিত সনাক্তকরণ করে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগের কার্যকর নজরদারি ও ব্যবস্থাপনায় সহায়ক।
বিশেষ করে, ISRO-র উন্নয়নধীন ও সম্প্রতি উৎক্ষেপিত উপগ্রহগুলি অপারেশন সিন্দুরের মতো সামরিক অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অপারেশন সিন্দুরের সময় ভারত সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিতে সঠিক আক্রমণ চালিয়েছে, যেখানে উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই সময় ভারতের আকাশতীর ও S-400 ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাও উপগ্রহ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে হওয়া আকাশ আক্রমণকে সফলভাবে প্রতিহত করেছে।
ভারতের মহাকাশ প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভারত মহাকাশ প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করার জন্য অনেক নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- মহাকাশ ভিত্তিক নজরদারি ও কাউন্টারস্পেস প্রযুক্তি: ভারত মহাকাশে তার কার্যকলাপ ও উপগ্রহের সুরক্ষার জন্য উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উন্নয়ন করছে।
- উপগ্রহ নক্ষত্রপুঞ্জ: অনেক ছোট উপগ্রহের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা যাতে যেকোনো এলাকার নজরদারি ব্যাপক ও দ্রুততর হয়।
- ড্রোন ও উচ্চ প্রযুক্তিগত গুপ্তচরবৃত্তি: উপগ্রহের পাশাপাশি ড্রোন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেও নজরদারি করা হচ্ছে।
এছাড়াও ভারত সম্প্রতি G20 দেশগুলির জন্য একটি বিশেষ উপগ্রহ উন্নয়ন করেছে, যা জলবায়ু, বায়ু দূষণ ও আবহাওয়ার নজরদারি করবে, যার ফলে পরিবেশগত সুরক্ষাও নিশ্চিত করা যাবে।