মহাদেব গোবিন্দ রানাডে: মহাদেব গোবিন্দ রানাডের পুণ্যতিথি ১৬ জানুয়ারি পালিত হয়। ১৮ জানুয়ারি ১৮৪২ সালে মহারাষ্ট্রের নাশিক জেলার নিফাড় তালুকে জন্মগ্রহণ করেন রাও বাহাদুর মহাদেব গোবিন্দ রানাডে। ভারতীয় সমাজ সংস্কারকদের মধ্যে তাঁর নাম অত্যন্ত সম্মানের সাথে উল্লেখিত হয়। তিনি ভারতীয় সমাজের প্রাচীন ও জটিল প্রথাগুলির সংস্কারের দিকে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। সমাজ সংস্কার, শিক্ষা, নারীর অধিকার এবং বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত অগ্রগামী। তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন ছিলেন এবং জনজীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, যার মধ্যে বোম্বাই উচ্চ ন্যায়ালয়ের বিচারপতির পদ অন্যতম।
প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
মহাদেব গোবিন্দ রানাডের শৈশব কেটেছে এক শিক্ষিত ও সংস্কৃত পরিবারে। তাঁর পরিবার তাঁকে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত করেছিল এবং ফলে তাঁর ছোটবেলা থেকেই জ্ঞানের প্রতি ঝোঁক ছিল। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা কোলহাপুরের একটি মারাঠি স্কুলে লাভ করেন এবং পরে বোম্বাইয়ের এলফিনস্টন কলেজে ভর্তি হন। ১৮৬২ সালে ইতিহাস ও অর্থনীতিতে বিএ ডিগ্রি লাভ করার পর ১৮৬৪ সালে ইতিহাসে এমএ এবং ১৮৬৬ সালে আইন বিষয়ে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিচার বিভাগীয় কর্মজীবন: রানাডের বিচার বিভাগে অবদান
রানাডে ১৮৭১ সালে পুনেতে অধস্তন বিচারক হিসেবে কর্মজীবনের সূচনা করেন। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক ও জনসাধারণের কাজের কারণে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত বোম্বাই উচ্চ ন্যায়ালয়ে তাঁর উন্নয়নে বিলম্ব করে। এরপরও তিনি ভারতীয় বিচার বিভাগের একজন মহান বিচারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁর রায় ও কাজ কেবল আইনের পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সমাজের জন্য সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গিও উপস্থাপন করেছিল।
সমাজ সংস্কার: নারীর অধিকার ও শিক্ষার দিকে কাজ
মহাদেব গোবিন্দ রানাডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল ভারতীয় সমাজে নারীর অধিকারের জন্য। তিনি পর্দা প্রথা ও শিশু বিবাহের মতো অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। এছাড়াও, রানাডে বিধবা পুনর্বিবাহ, নারী শিক্ষা ও সমতা ইত্যাদি বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। ১৮৬১ সালে তিনি ‘বিধবা বিবাহ সংঘ’র সহ-প্রতিষ্ঠা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু বিধবাদের জন্য বিবাহের প্রচার করা। রানাডের বিশ্বাস ছিল যে, যতক্ষণ না নারীরা সমান অধিকার ও শিক্ষার সুযোগ পাবে, ততক্ষণ সমাজের অগ্রগতি হবে না।
১৮৮৫ সালে, রানাডে বামন আবাজী মোদক ও ডাঃ আর.জি. ভান্ডারকারের সাথে মিলে মহারাষ্ট্র গার্লস এডুকেশন সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর আওতায় তিনি পুনেতে একটি মেয়েদের উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যা ‘হুজুরপাগা’ নামে পরিচিত।
প্রার্থনা সমাজ ও ধর্মীয় সংস্কার
মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ১৮৬৭ সালে প্রার্থনা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল একটি ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কার সংগঠন। এই সমাজের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় সমাজে বিদ্যমান ধর্মীয় কুসংস্কার দূর করা এবং সমতার প্রতিষ্ঠা করা। রানাডে প্রার্থনা সমাজের মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান অন্ধবিশ্বাস ও অজ্ঞতা দূর করার চেষ্টা করেছিলেন।
বিচার ও সমাজিক বিষয় নিয়ে রানাডের দৃষ্টিভঙ্গি
রানাডের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তাঁর সমাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে তিনি ভারতীয় সমাজের জড়তা ও পিছিয়ে পড়া অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাঁর মতে, ভারতীয় সমাজকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমাজ সংস্কার করা অত্যন্ত প্রয়োজন। তিনি ভারতীয় সমাজের অনেক প্রথা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন, যেমন: জাতিভেদ, নারীর প্রতি বৈষম্য এবং সমাজে বিদ্যমান অনিশ্চয়তা।
মহাদেব গোবিন্দ রানাডের ব্যক্তিগত জীবন ও বিবাহ
মহাদেব গোবিন্দ রানাডের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার তাঁকে পুনর্বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এই প্রসঙ্গে রানাডে ভারতীয় সমাজের প্রথা ও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে বিবেচনা করে বিধবা বিবাহ সংঘের নীতি অনুসরণ করেন। তিনি রমাভাইয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যিনি তাঁর চেয়ে ২০ বছর ছোট ছিলেন। এই বিবাহ নিয়ে রানাডে সমালোচনার সম্মুখীন হন, কিন্তু তিনি নিজের চিন্তাধারায় অটুট থাকেন এবং সমাজ সংস্কারের প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত রাখেন।
মহাদেব গোবিন্দ রানাডের স্থায়ী অবদান
মহাদেব গোবিন্দ রানাডে তাঁর জীবদ্দশায় ভারতীয় সমাজের সংস্কারের জন্য অমূল্য কাজ করেছেন। তাঁর চিন্তাধারা ও কাজ আজও সমাজে অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর রচনা, সমাজসেবা ও বিচার বিভাগীয় দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় সমাজকে কেবল সংস্কারের দিকেই নির্দেশ করে নি, বরং একটি নতুন চিন্তাধারা ও মানসিকতারও জন্ম দিয়েছে।
তাঁর অবদান ভারতীয় সমাজকে একটি নতুন দিক দান করেছিল এবং তিনি সর্বদাই ভারতীয় সমাজের সংস্কারক ও ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে স্মরণীয় থাকবেন।