ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে বর্ধমান সংঘাত ভারতের জন্য নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এই সংঘাতের সরাসরি প্রভাব ভারতের শক্তি নিরাপত্তা, বাণিজ্যপথ এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের উপর পড়তে পারে।
নয়াদিল্লি: পশ্চিম এশিয়া আবারও ভয়াবহ উত্তেজনার আগুনে জ্বলছে। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে গভীরতর সামরিক সংঘাত শুধুমাত্র আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেই চ্যালেঞ্জ করেনি, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশকেও তাদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। ভারতও এই ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের বাইরে নয়। যদিও ভারত এই সংঘাতের অংশ নয়, তবুও এই সংঘাতের জ্বালা তার শক্তি নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং কৌশলগত কৌশলকে প্রভাবিত করছে।
ভারতের জটিল অবস্থা
ভারতের জন্য এই অবস্থা আরও জটিল কারণ তার ইরান ও ইসরায়েল উভয়ের সাথেই কৌশলগত, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সম্পর্ক গভীর। ইসরায়েল, যেখান থেকে ভারত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এবং উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ পায়, অন্যদিকে ইরান ভারতের শক্তি আমদানির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস এবং চাবাহার বন্দরের মতো কৌশলগত প্রকল্পে ভারতের অংশীদারিত্ব রয়েছে।
একদিকে ইসরায়েল থেকে ভারত ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, ড্রোন সিস্টেম এবং সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কিত সংস্থান পায়, অন্যদিকে ইরান ভারতকে তুলনামূলকভাবে কম দামে কাঁচা তেল সরবরাহ করে আসছে। यही কারণে ভারতের জন্য একপক্ষের সমর্থন করা শুধুমাত্র কঠিন নয়, বরং সম্ভবত ব্যয়বহুলও হতে পারে।
ইরান ও ইসরায়েলের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সমীকরণ
২০২৪-২৫ অর্থবছরের পরিসংখ্যান দেখায় যে, ভারত ইরানে প্রায় ১.২৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করেছে, এবং সেখান থেকে ৪৪১.৯ কোটি ডলারের আমদানি করেছে। এতে মূলত পেট্রোলিয়াম পণ্য ও খনিজ অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, ইসরায়েলের সাথে ভারতের বাণিজ্য আরও বেশি। ভারত ইসরায়েলে ২.১৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করেছে এবং ১.৬১ বিলিয়ন ডলারের আমদানি করেছে। প্রতিরক্ষা ও সাইবার প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইসরায়েল ভারতের একজন প্রধান সহযোগী হয়ে উঠেছে।
এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, ভারতের জন্য উভয় দেশের সাথেই সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন। একদিকে শক্তি নিরাপত্তার প্রশ্ন, অন্যদিকে কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্ব।
ভারতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ: শক্তি নিরাপত্তা
ভারত আজ তার শক্তির চাহিদার ৮০ শতাংশেরও বেশি আমদানি করে, যার মধ্যে বেশিরভাগ কাঁচা তেল ও এলএনজি পশ্চিম এশিয়া থেকে আসে। এই তেল হর্মুজ जलडमरूमध्यের মাধ্যমে ভারতে পৌঁছায়, যা একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল সমুদ্রপথ। এই जलडमरूमध्य তার সবচেয়ে সংকীর্ণ স্থানে মাত্র ২১ মাইল চওড়া এবং বিশ্বব্যাপী কাঁচা তেল ব্যবসায়ের পঞ্চম ভাগ এই পথ দিয়ে যায়।
যদি ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি আরও গুরুতর হয়, তাহলে প্রথম প্রভাব এই পথেই দেখা যাবে। এতে ভারতে তেল ও গ্যাসের সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে, যার ফলে পেট্রোল-ডিজেলের দাম বৃদ্ধি, শিপিং খরচ ও বীমা প্রিমিয়াম বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি নিশ্চিত বলে মনে করা হচ্ছে।
বাণিজ্যপথও বিপদে
ভারতের ইউরোপ, আফ্রিকা এবং আমেরিকার পূর্ব উপকূলে রপ্তানি হওয়া প্রায় ৩০ শতাংশ পণ্য বাব-এল-মান্দেব जलडमरूमध्य দিয়ে যায়। যদি এই পথে নিরাপত্তা সংকট বৃদ্ধি পায়, তাহলে ভারতকে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অফ গুড হোপের পথে পণ্য পাঠাতে হবে, যার ফলে পণ্য সরবরাহ দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বিলম্বিত হতে পারে। এর সরাসরি প্রভাব ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য, বস্ত্র এবং রাসায়নিক রপ্তানির উপর পড়বে।
ভারতকে কী করা উচিত?
এই পরিস্থিতি বিবেচনা করে, গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই) ভারত সরকারকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছে। জিটিআরআই মনে করে যে, ভারত যদিও এই যুদ্ধে জড়িত নয়, তবুও এটি উপেক্ষা করতে পারে না। তাকে তার কৌশলগত তেল মজুতের পর্যালোচনা করা উচিত এবং নিশ্চিত করা উচিত যে, তারা যেকোনো জরুরি অবস্থায় দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
ভারতকে তেল আমদানির জন্য অন্যান্য দেশের দিকে ধাবমান হতে হবে। আফ্রিকা, আমেরিকা এবং রাশিয়ার মতো বিকল্প উৎস থেকে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করতে হবে যাতে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সরাসরি প্রভাব তার অর্থনীতিতে না পড়ে।
সামরিক ও কূটনৈতিক প্রস্তুতি প্রয়োজন
জিটিআরআইয়ের প্রতিবেদনে আরব সাগর এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের কাছে ভারতের নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। হর্মুজ ও বাব-এল-মান্দেবের মতো চোক পয়েন্টের নিরাপত্তায় ভারতকে তার সামরিক প্রস্তুতি শক্তিশালী করতে হবে।
কূটনৈতিক পর্যায়ে ভারতকে জাতিসংঘ, জি-২০ এবং ব্রিক্সের মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি স্থাপন ও উত্তেজনা কমানোর দিকে কাজ করতে হবে। ভারতকে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যপথ যে কোনও ধরনের বাধা থেকে সুরক্ষিত থাকে।
কী ভারত কোনও এক পক্ষের সাথে
ইতিহাস বলছে যে, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ভারসাম্য ও অসংশ্লিষ্টতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ভারত সর্বদা উভয় পক্ষ থেকে স্বাধীন সম্পর্ক বজায় রেখেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতেও ভারতের এই কৌশলই সঠিক বলে মনে হয়। ইসরায়েল ও ইরান উভয়েই ভারতের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, এবং এর মধ্যে যেকোনও একটির ত্যাগ ভারতের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের বিরুদ্ধে হবে।
যেখানে ইসরায়েল ভারতের প্রধান প্রতিরক্ষা সহযোগী, সেখানে ইরান ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া পর্যন্ত পৌঁছানোর একমাত্র স্থলপথ। চাবাহার বন্দর প্রকল্প ও আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডোর (INSTC) এর মতো প্রকল্পে ইরানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।