বেঙ্গালুরুর উচ্চ বেতনও কি মূল্যস্ফীতির সামনে ফিকে?

🎧 Listen in Audio
0:00

বর্ধমান মূল্যস্ফীতি এবং জীবিকার ব্যয় ভারতের বড় শহরগুলির, বিশেষ করে আইটি হাব বেঙ্গালুরুর কর্মজীবীদের আর্থিক অবস্থার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই প্রসঙ্গেই একটি পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ভাইরাল হচ্ছে।

বেঙ্গালুরু: দেশের প্রধান টেক হাব বেঙ্গালুরু থেকে একটি চমকপ্রদ বিতর্ক সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। যেখানে সাধারণত ৫০ লক্ষ টাকা বার্ষিক বেতনকে অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী বলে মনে করা হয়, সেখানে এখন তা নতুন করে ২৫ লক্ষ বলে বলা হচ্ছে। এই বক্তব্য ইন্টারনেটে তোড়োড়ো করেছে। কেউ কেউ এটিকে সমর্থন করছেন, আবার কেউ কেউ এর পরিসংখ্যান এবং চিন্তাধারার উপর প্রশ্ন তুলেছেন। এই বিতর্কের মূল বিষয় হল – বেঙ্গালুরুতে বর্ধমান মূল্যস্ফীতি এবং উচ্চ বেতনের পরও ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস।

ভাইরাল হওয়া একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ টুইট

এই পুরো বিতর্কের শুরু হয়েছিল একটি টুইট থেকে, যেখানে ব্যবহারকারী সৌরভ দত্ত লিখেছেন
আমি শুনেছি বেঙ্গালুরুর আইটি সেক্টরে অনেকেই ৫০ লক্ষ টাকা বার্ষিক আয় করছেন। হয় তারা তাদের CTC বৃদ্ধি করে দেখাচ্ছেন, নয়তো ৫০ লক্ষ টাকা বার্ষিক এখন ২৫ লক্ষ টাকার সমান হয়ে গেছে।

এই টুইট সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। হাজার হাজার মানুষ এ বিষয়ে তাদের মতামত দিয়েছেন, কেউ হ্যাঁ তে কেউ না-তে।

মূল্যস্ফীতির সামনে ফিকে হয়ে গেছে মোটা বেতন?

বেঙ্গালুরুকে ভারতের সিলিকন ভ্যালি বলা হয়, কিন্তু এখানকার মূল্যস্ফীতিও কোনও মেট্রো শহরের চেয়ে কম নয়। বিশেষ করে ভাড়া, স্কুলের ফি, চিকিৎসা ব্যয়, খাবার এবং ব্যক্তিগত যানবাহনের খরচ এখানে বসবাসকারী উচ্চ বেতনভোগী কর্মীদের কাঁধে বড় বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।

একজন ব্যবহারকারী প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লিখেছেন

৫০ লক্ষ টাকা এখন ১০ লক্ষ টাকার মতো মনে হয়। ভাড়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের ফি, ব্যক্তিগত গাড়ি, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং EMI সবকিছু গ্রাস করে নিয়েছে।

আরেকজন ব্যবহারকারী বলেছেন
যদি আপনি বেঙ্গালুরুতে থাকেন এবং ১ কোটি টাকা আয় না করেন, তাহলে হয়তো আপনি আপনার সময় নষ্ট করছেন।

টেক ইন্ডাস্ট্রির সত্যতা: CTC এবং টেক-হোমে বড় পার্থক্য

বিতর্কের একটি বড় অংশ এই বিষয়ের উপর কেন্দ্রীভূত ছিল যে CTC (Cost To Company) এবং টেক-হোম বেতনের মধ্যে কতটা পার্থক্য রয়েছে। টেক সেক্টরে বড় বড় কোম্পানি যেমন Microsoft, Amazon, Google ইত্যাদি তাদের কর্মীদের প্রচুর CTC প্যাকেজ দেয়, কিন্তু তার মধ্যে বেশিরভাগ অংশ RSU (Restricted Stock Units), বোনাস, বীমা এবং PF-এ চলে যায়।

একজন ব্যবহারকারী জানিয়েছেন
Microsoft ৫০ লক্ষ টাকার প্যাকেজ দেয়, কিন্তু তার মধ্যে মূল বেতন মাত্র ১৬ লক্ষ টাকা। বাকি টাকা ৩-৪ বছরে নষ্ট হওয়া স্টকের মধ্যে থাকে। আসলে টেক হোম বেতন অনেক সময় ১.২ লক্ষ টাকার বেশি হয় না।

জীবনযাত্রার ধরণও দায়ী?

বেঙ্গালুরুর জীবনযাত্রার ধরণও উচ্চ আয়কারীদের উপর চাপ ফেলছে। ভালো বাড়ি, আন্তর্জাতিক স্কুলে পড়াশোনা, গাড়ির কিস্তি, ভ্রমণ এবং সপ্তাহান্তের পার্টি – এগুলি মিলে একজন সাধারণ মিড সিনিয়র টেক কর্মীর পকেটে বড় বোঝা চাপায়।

একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন
আমার ৫০ লক্ষ টাকার প্যাকেজ আছে, কিন্তু মাসের শেষে সঞ্চয় নগণ্য। কখনও ট্রাফিকে আটকে থাকা, কখনও ছেলেমেয়েদের ফি পরিশোধ করা, সব টাকাই খরচ হয়ে যায়।

শুধুমাত্র বেঙ্গালুরুর ক্ষেত্রেই কি?

এই বিতর্ক দেখে অনেকে অন্যান্য শহরগুলির সাথে তুলনা করেছেন।

একজন ব্যবহারকারী বলেছেন
এটা শুধুমাত্র বেঙ্গালুরুর কথা। হায়দ্রাবাদে ২৫ লক্ষ টাকা এখনও ২৫ লক্ষ টাকার মতো মনে হয়। দিল্লি এবং পুনেতেও খরচ কম।

এই থেকে বোঝা যায় যে শহরের Cost of Living Index কত বড় ভূমিকা পালন করে। বেঙ্গালুরুতে রিয়েল এস্টেটের দাম, ট্রাফিক, জ্বালানী খরচ এবং ব্যক্তিগত সেবা বেশি ব্যয়বহুল। এর ফলে উচ্চ বেতনও সাধারণ জীবনে নিম্নস্তরের সন্তুষ্টি দেয়।

২০০৫ বনাম ২০২৫: বেতনের মূল্যে হ্রাস

একজন ব্যবহারকারী কমেন্টে প্রশ্ন করেছেন যে "আপনি কোন বছরের সাথে তুলনা করছেন?" এই প্রশ্নটি এই বিষয়টি নির্দেশ করে যে গত ১৫-২০ বছরে মুদ্রাস্ফীতির কারণে টাকার ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত কমে চলেছে। ২০০৫ সালে ৫০ লক্ষ টাকার যে মূল্য ছিল, আজ সেই টাকায় একটি গড় জীবনযাত্রাও কঠিন মনে হয়।

এখানে একটি উদাহরণ দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে – ২০০৫ সালে বেঙ্গালুরুর হোয়াইটফিল্ডের মতো এলাকায় ২BHK ফ্ল্যাট ৩০-৩৫ লক্ষ টাকায় পাওয়া যেত, আজ সেই ফ্ল্যাট এক কোটি টাকার উপরে হয়ে গেছে। স্কুলের ফি যেখানে আগে ২০-২৫ হাজার টাকা বার্ষিক ছিল, এখন লক্ষ লক্ষ টাকা।

সমাজে গড়ে ওঠা ছবি এবং মানসিক চাপ

এই বিতর্কে আরেকটি আকর্ষণীয় দিক উঠে এসেছে – সামাজিক অবস্থা এবং দেখানোর চাপ। উচ্চ বেতন পাওয়া ব্যক্তিরা প্রায়শই তাদের জীবনযাত্রা, পোশাক, গাড়ি এবং ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি মান বজায় রাখতে চান। এর ফলে তাদের উপর আর্থিক চাপ আরও বেড়ে যায়।

অনেক মানুষ এটাও লিখেছেন যে টেক কোম্পানিতে কাজ করা ব্যক্তিদের কাছে "এলিট" জীবনযাপনের আশা করা হয়, যার ফলে মানসিক চাপ এবং ব্যয় উভয়ই বৃদ্ধি পায়।

কী সমাধান?

  • এই বিতর্কের মাঝে অনেকেই কিছু ইতিবাচক পরামর্শও দিয়েছেন। যেমন:
  • ব্যক্তিগত বাজেটিং: আপনার মাসিক আয় এবং ব্যয়ের একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করা
  • স্টক/RSU-র ভুল মূল্যায়ন না করা: স্টকের মূল্য কখনোই কমতে পারে, এটাকে আপনার স্থায়ী আয় বলে মনে না করা
  • স্মার্ট বিনিয়োগ: অযথা খরচের পরিবর্তে মিউচুয়াল ফান্ড, SIP এবং ফিক্সড ডিপোজিটের মতো নিরাপদ মাধ্যমে বিনিয়োগ করা
  • কম খরচের এলাকায় বসবাস: বেঙ্গালুরুতে এমন এলাকা বেছে নেওয়া যেখানে ভাড়া কম এবং সংযোগ সুবিধা ভালো
  • ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সুবিধা নেওয়া: যদি সম্ভব হয়, তাহলে রিমোট ওয়ার্ক করে ছোট শহরে গিয়ে বেশি সঞ্চয় করা

Leave a comment