ভারত ও বিশ্বে ৫জি প্রযুক্তির আবির্ভাবের পর থেকেই এর সুবিধাগুলি আলোচনার বিষয় হলেও, এর সাথে জড়িত ঝুঁকিগুলিও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া ও কিছু গুজব ছড়ানো প্ল্যাটফর্মে দাবি করা হয়েছে যে ৫জি নেটওয়ার্কের তরঙ্গ শুধুমাত্র পাখির জন্যই নয়, মানুষের জন্যও ক্ষতিকারক হতে পারে। এই ধরণের দাবি মানুষের মনে ভয়ের সৃষ্টি করেছে, যার ফলে প্রযুক্তি নিয়ে সন্দেহের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখন বিজ্ঞানীদের একটি সাম্প্রতিক গবেষণা এই ভুল ধারণা সম্পূর্ণভাবে দূর করেছে।
৫জি ও মানবদেহ: কি সত্যিই কোনও ঝুঁকি আছে?
৫জি, অর্থাৎ ফিফথ জেনারেশন নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেটের নতুন প্রযুক্তি যা অত্যন্ত দ্রুত গতি ও খুব কম বাধা দিয়ে ডেটা ট্রান্সফার করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু ৫জি প্রযুক্তির আবির্ভাবের পর থেকেই আলোচনা চলে আসছে যে এর তরঙ্গ, অর্থাৎ রেডিও ওয়েভস, মানবদেহ, বিশেষ করে ত্বকের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অনেকের ভয় ছিল যে এই রেডিয়েশন দেহের ভেতরে ঢুকে আমাদের ডিএনএ বা জিনকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে স্বাস্থ্যের উপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।
এই আশঙ্কাগুলি দূর করার জন্য জার্মানির কনস্ট্রাক্টর ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা একটি গভীর গবেষণা করেছেন। এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা মানুষের ত্বকের কোষগুলিকে ৫জি-এর উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও ওয়েভসের সংস্পর্শে রেখেছেন। গবেষণার ফলাফল বেশ স্বস্তিদায়ক ছিল কারণ এতে দেখা গেছে যে এই তরঙ্গগুলির ডিএনএ বা জিনের কার্যকলাপের উপর কোনও প্রভাব পড়েনি। এর স্পষ্ট অর্থ হল সাধারণ অবস্থায় ৫জি প্রযুক্তি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক নয়।
গবেষণায় কীভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে?
এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা মানুষের ত্বকের দুটি প্রধান কোষ - কেরাটিনোসাইটস এবং ফাইব্রোব্লাস্ট - নির্বাচন করেছেন। এই কোষগুলিকে ২৭ GHz এবং ৪০.৫ GHz উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি ৫জি তরঙ্গের সংস্পর্শে ২ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত রাখা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষা করা যে কম বা দীর্ঘ সময় ধরে এই তরঙ্গের সংস্পর্শে থাকলে কোষগুলির উপর কোনও প্রভাব পড়ে কিনা।
গবেষণা দল বিশেষ করে এই কোষগুলির ডিএনএ এবং জিনের কার্যকলাপের উপর নজর রেখেছে। তারা জানতে চেয়েছিল ৫জি সিগন্যালের তরঙ্গ দেহের জেনেটিক গঠনে ক্ষতি করতে পারে কিংবা তাতে কোনও পরিবর্তন আনতে পারে কিনা।
ফলাফল: ডিএনএ-র উপর কোনও প্রভাব পড়েনি
গবেষণার ফলাফল বেশ স্বস্তিদায়ক। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ৫জি-এর উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি তরঙ্গের সংস্পর্শে আসার পরও তাদের ডিএনএ-তে কোনও ক্ষতি হয়নি। বিশেষ করে ডিএনএ মিথাইলেশনে কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি, যা নির্ধারণ করে জিনগুলি কীভাবে কাজ করবে।
সহজ ভাষায় বললে, ৫জি রেডিয়েশন থেকে মানবদেহের কোষ সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। জিনের গঠন পরিবর্তন হয়নি এবং কোষগুলির কোনও চাপ বা ঝুঁকি অনুভূত হয়নি। এর অর্থ হল ৫জি প্রযুক্তি থেকে মানুষের কোনও জেনেটিক ক্ষতি হয় না।
তাপমাত্রার প্রভাব: একমাত্র সতর্কতা
বিজ্ঞানীরা এটাও বলেছেন যে ৫জি-এর তরঙ্গ যদি অত্যধিক তাপ উৎপন্ন করে তাহলে তা দেহের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। কিন্তু এই গবেষণায় তাপমাত্রা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল যাতে কোনও অতিরিক্ত তাপ না বাড়ে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত দেহে অতিরিক্ত তাপ না বাড়ে, ততক্ষণ ৫জি-এর তরঙ্গ নিরাপদ থাকে।
এর অর্থ হল যদি আপনার ফোন বা নেটওয়ার্ক অত্যধিক গরম না হয়, তাহলে আপনাকে ৫জি থেকে ভয় পাওয়ার দরকার নেই। সাধারণ অবস্থায় ৫জি প্রযুক্তি মানুষের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং এর থেকে কোনও ঝুঁকি নেই।
গবেষণার বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব ও প্রকাশনা
এই গবেষণাটি PNAS Nexus নামক একটি প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত খ্যাত ও বিশ্বাসযোগ্য। এই জার্নালে শুধুমাত্র সেই ধরণের গবেষণাকে স্থান দেওয়া হয় যা গভীরভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং যার মধ্যে স্বচ্ছতা রয়েছে। তাই এই গবেষণার নির্ভুলতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। গবেষণায় ব্যবহৃত পদ্ধতি ও ফলাফলের স্পষ্টতা এটিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।
এখন যখন বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে ৫জি প্রযুক্তি থেকে মানবদেহের কোনও ক্ষতি হয় না, তখন এই তথ্যটি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এতে ৫জি নিয়ে ছড়িয়ে থাকা ভয় ও ভুল ধারণা কম করা যাবে। মানুষকে সঠিক তথ্য বোঝানোর মাধ্যমে তারা কোনও উদ্বেগ ছাড়াই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে এবং এর সুবিধাগুলি উপভোগ করতে পারবে। এইভাবে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি সমাজের জন্য নিরাপদ ও লাভজনক হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।
৫জি নিয়ে ছড়িয়ে থাকা গুজবের অবসান?
৫জি নিয়ে অনেক গুজব প্রচারিত হয়েছে, যেমন এটি পাখির মৃত্যুর কারণ হয়, ক্যান্সার ছড়ায়, অথবা শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে। কিন্তু এই সকল দাবির কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সম্প্রতি জার্মানির বিজ্ঞানীরা যে গবেষণা করেছেন তা এই সকল গুজবকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করেছে। এই গবেষণায় স্পষ্ট করা হয়েছে যে ৫জি নেটওয়ার্ক সাধারণ ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মানুষের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং এটি স্বাস্থ্যের কোনও ঝুঁকি সৃষ্টি করে না। তাই এখন বুঝতে হবে যে ৫জি সম্পর্কে ভয় ও ভুল ধারণা অমূলক।
ভারতে ৫জি ও সচেতনতার প্রয়োজন
ভারতে ৫জি নেটওয়ার্কের সেবা শুরু হয়ে গেছে এবং মানুষও এ নিয়ে বেশ উৎসাহিত। কিন্তু এর সাথে সাথে কিছু জায়গায় এখনও ৫জি নিয়ে ভয় ও ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকা ও সেসব এলাকায় যেখানে প্রযুক্তিগত তথ্যের অভাব রয়েছে। সেখানকার মানুষ মনে করে যে ৫জি টাওয়ারের তরঙ্গ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে অথবা রোগ ছড়াতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ও টেক কোম্পানির দায়িত্ব হল এই ধরণের গুজব দূর করা এবং মানুষকে সঠিক তথ্য দেওয়া। বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রমাণের মাধ্যমে মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া জরুরি যে ৫জি সম্পূর্ণ নিরাপদ প্রযুক্তি এবং এর থেকে কোনও ক্ষতি হয় না। এতে শুধুমাত্র মানুষের আস্থা বাড়বে না, ৫জি-এর সুবিধাগুলিও সঠিকভাবে পৌঁছে যাবে।
এই গবেষণা থেকে যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা উঠে এসেছে তা হল নতুন প্রযুক্তি থেকে ভয় পাওয়ার পরিবর্তে তা বুঝতে হবে। ৫জি নেটওয়ার্ক শুধুমাত্র ইন্টারনেটের জগতে বিপ্লব আনছে না, বরং এটি আমাদের জীবনকে আরও স্মার্ট, দ্রুত ও সুবিধাজনক করে তুলছে। যদি এর ব্যবহার থেকে কোনও বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকত, তাহলে বিজ্ঞানী ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর অনুমতি কখনোই দিত না।