খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু, পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যু হয়েছে। তিনি ৮৮ বছর বয়সী ছিলেন এবং দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত তাঁর বাসভবন ‘কাশা সান্তা মার্তা’তে তাঁর মৃত্যু হয়।
ভ্যাটিকান সিটি: খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মগুরু, পোপ ফ্রান্সিসের আজ (২১শে এপ্রিল) ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছে। কিছুদিন ধরে তিনি গুরুতর অসুস্থ ছিলেন এবং ভ্যাটিকান সিটি সোমবার তাঁর মৃত্যুর সরকারি ঘোষণা করে। পোপ ফ্রান্সিসের জন্ম আর্জেন্টিনায় হয়েছিল এবং তিনি প্রথম লেটিন আমেরিকান ধর্মগুরু যিনি ২০০৩ সালে ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ পদ, পোপের পদ পান।
পোপ হিসেবে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর, তিনি চার্চের সংস্কার এবং সমাজে সমতা, দরিদ্র ও নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য তাঁর কণ্ঠ উত্তোলনের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
পোপ ফ্রান্সিসের আসল নাম ও শৈশব
পোপ ফ্রান্সিসের আসল নাম জর্জ মারিও বেরগোগলিও ছিল। তাঁর জন্ম ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্সে। তাঁর পিতামাতা ইতালি থেকে আগত অভিবাসী ছিলেন। তাঁর পিতা একজন অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন এবং মা গৃহিণী। বেরগোগলিওর শৈশব ছিল সাধারণ, কিন্তু তাঁর ধর্মীয় জীবনের প্রতি ঝোঁক ছিল শুরু থেকেই। তিনি প্রাথমিক শিক্ষার সময় বিজ্ঞান পড়াশোনা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর মনে এক গভীর আস্থার অনুভূতি এবং ঈশ্বরের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে উঠেছিল।
ধর্মীয় জীবনের সূচনা
জর্জ বেরগোগলিও ১৯৫৮ সালে ২১ বছর বয়সে জেসুইট সম্প্রদায়ের সাথে যোগ দিয়ে ধর্মীয় জীবনের সূচনা করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পাদ্রী হন এবং এরপর স্পেনে ধর্মের গভীর শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর ধর্মীয় জীবন সম্পূর্ণরূপে সেবা, করুণা ও ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে চার্চে তাঁর নাম পরিচিত হয়ে ওঠে এবং ১৯৭৩ সালে তাঁকে আর্জেন্টিনায় জেসুইট সম্প্রদায়ের প্রধান নিযুক্ত করা হয়।
পোপ হিসেবে যাত্রা
পোপ ফ্রান্সিসের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় ২০০৩ সালে আসে, যখন তাঁকে ক্যাথলিক চার্চের ২৬৬তম পোপ নির্বাচিত করা হয়। তিনি প্রথম লেটিন আমেরিকান পোপ এবং প্রথম জেসুইট পোপ ছিলেন। তাঁর নাম রাখা হয় ফ্রান্সিস, যা সাদামাটা, সেবা ও দরিদ্রদের প্রতি ভালোবাসার প্রতীক। এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ বেনেডিক্ট XVI স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন এবং তাঁর পর একজন জীবিত পোপের নির্বাচন হয়েছিল। পোপ ফ্রান্সিসের নির্বাচিত হওয়ার মুহূর্ত চার্চের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ছিল, কারণ তিনি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সেবার নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
পোপ ফ্রান্সিসের कार्यकालের প্রধান উদ্যোগ
পোপ ফ্রান্সিস তাঁর कार्यकालে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যা কেবল চার্চ নয়, পুরো বিশ্বের জন্যই একটি বার্তা ছিল। তিনি ধর্মীয় জীবনকে সহজ ও সুসংগঠিত করার জন্য অনেক সংস্কার করেছিলেন।
১. শরণার্থীদের পায়ের ধোয়ার রীতি
২০১৬ সালে, পোপ ফ্রান্সিস শরণার্থীদের পায়ের ধোয়ার রীতি চালু করেন, যা তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে। শরণার্থীদের পায়ের ধুয়ে তিনি এই বার্তা দেন যে সকলেই সমান এবং সেবার কোনো বৈষম্য হওয়া উচিত নয়। এটি তাঁর একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ছিল, যা বিশ্বজুড়ে ধর্ম ও সহিষ্ণুতার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিল।
২. অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা
২০১৮ সালে আয়ারল্যান্ডে চার্চের অপরাধের জন্য পোপ ফ্রান্সিস সর্বজনীন ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পোপ ফ্রান্সিস স্বীকার করেন যে চার্চের কিছু পাদ্রী ও ধর্মগুরু শিশুদের সাথে যৌন নির্যাতন করেছে। তিনি এই অত্যাচার স্বীকার করে এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং এর তীব্র প্রতিবাদ করেন।
৩. যৌন নির্যাতনের ঘটনার জানানো বাধ্যতামূলক করা
২০১৯ সালে পোপ ফ্রান্সিস একটি গুরুত্বপূর্ণ আদেশ জারি করেন, যার অধীনে সকল পাদ্রী ও ধর্মীয় ব্যক্তিকে যৌন নির্যাতনের ঘটনার কথা জানানো বাধ্যতামূলক করা হয়। এই পদক্ষেপ চার্চে স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০২৩ সালে এই নিয়ম সাধারণ চার্চ নেতাদের উপরও প্রযোজ্য করা হয়।
৪. ধর্মীয় সংস্কার ও অন্তর্ভুক্তি
পোপ ফ্রান্সিস তাঁর कार्यकालে চার্চে সংস্কার প্রয়োগ করেন, যা অন্তর্ভুক্তি ও বৈচিত্র্যের সম্মান করে। তিনি চার্চকে আরও বেশি মহিলা সবলীকরণ ও যুবকদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেন।
সামাজিক ন্যায়বিচার ও পরিবেশ সংরক্ষণ
পোপ ফ্রান্সিসের উদ্বেগের বিষয় ছিল কেবল চার্চ ও খ্রিস্টধর্ম নয়, বরং সমাজ ও পরিবেশও। তাঁর প্রকাশিত ‘লাউদাতো সি’ নামক দলিলে পরিবেশ রক্ষা ও পৃথিবীর প্রতি দায়িত্ববোধের কথা বলা হয়েছে। পোপ বিশ্বজুড়ে পরিবেশগত সংকট নিয়ে সচেতনতা ছড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন এবং ব্যাখ্যা করেছিলেন যে পৃথিবী আমাদের জননী, এবং আমাদের এটিকে রক্ষা করার জন্য আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
পোপ ফ্রান্সিসের জীবন ধর্মের মধ্যে সংলাপ এবং বিশ্ব শান্তির জন্য উৎসর্গীকৃত ছিল। তিনি মুসলিম, ইহুদী ও অন্যান্য ধর্মীয় নেতাদের সাথে মিলে শান্তি ও সহিষ্ণুতার বার্তা দিয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে বিশ্বে শান্তি তখনই সম্ভব যখন আমরা একে অপরের ধর্ম ও সংস্কৃতির সম্মান করব।
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যু: শোক ও শ্রদ্ধাঞ্জলি
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর, বিশ্বের নেতারা ও সাধারণ মানুষ শোক প্রকাশ করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইট করে লিখেছেন, "পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর জীবন ছিল সেবা, করুণা ও শান্তির প্রতীক।" ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিও পোপ ফ্রান্সিসের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছেন।
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর, ভ্যাটিকান সিটি তাঁর শেষকৃত্যের প্রস্তুতি শুরু করেছে। এখন চার্চের পরবর্তী পোপ নির্বাচনের জন্য কঙ্ক্লেভের প্রক্রিয়া শুরু হবে।