তামিলনাড়ুতে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যার শিকড় ১৯৩০ সাল থেকে। স্ট্যালিন কেন্দ্রকে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। নতুন শিক্ষানীতি এবং সংসদীয় সুপারিশের ফলে বিতর্ক আবার তীব্র হয়ে উঠেছে।
দক্ষিণ ভারতে হিন্দি বিতর্ক: তামিলনাড়ু সহ দক্ষিণ ভারতের অনেক রাজ্যে হিন্দি বনাম আঞ্চলিক ভাষার বিতর্ক আবার একবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম.কে. স্ট্যালিন কেন্দ্রীয় সরকারের উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ এনে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এছাড়াও, কেরাল এবং কর্ণাটকেও হিন্দি ভাষা নিয়ে প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে।
এটি প্রথমবার নয় যখন দক্ষিণ ভারতে হিন্দি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। তামিলনাড়ুতে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের শিকড় স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে বিদ্যমান। ১৯৩০-এর দশক থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই বিষয়ে বড় বড় আন্দোলন হয়েছে, যাতে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে এবং হাজার হাজার লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। বর্তমানে নতুন শিক্ষানীতি এবং সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ফলে এই বিতর্ক আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে।
১৯৩০-এর দশকে শুরু হয়েছিল হিন্দি-বিরোধী আন্দোলন
তামিলনাড়ুতে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের ভিত্তি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ই স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৩০-এর দশকে যখন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে কংগ্রেস সরকার স্কুলগুলিতে হিন্দিকে একটি বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রাখে, তখন তার তীব্র প্রতিবাদ হয়। সমাজ সংস্কারক ই.ভি. রামাস্বামী (পেরিয়ার) এবং জাস্টিস পার্টি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মোর্চা স্থাপন করে।
এই আন্দোলন প্রায় তিন বছর ধরে চলে, যার সময় দুইজন প্রতিবাদকারীর মৃত্যু হয় এবং এক হাজারেরও বেশি লোক গ্রেপ্তার হয়। হিন্দি-বিরোধী এই প্রথম সংগঠিত আন্দোলন ছিল, যা তামিলনাড়ুর রাজনীতি এবং সমাজের উপর গভীর ছাপ রেখে গেছে।
১৯৪৬-১৯৫০: হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়
১৯৪৬ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় দেখা যায়। যখনই সরকার স্কুলগুলিতে হিন্দিকে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করেছে, তখনই প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। অবশেষে একটি চুক্তির মাধ্যমে হিন্দিকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে স্বীকার করা হয়, যার ফলে এই বিতর্ক কিছুটা শান্ত হয়।
নেহেরুর আশ্বাস এবং ১৯৬৩ সালের হিন্দি-বিরোধী আন্দোলন
নেহেরু দিয়েছিলেন ইংরেজি চালিয়ে যাওয়ার গ্যারান্টি
১৯৫৯ সালে যখন হিন্দি নিয়ে বিতর্ক বৃদ্ধি পায়, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সংসদে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, অ-হিন্দিভাষী রাজ্য ইংরেজি কতক্ষণ পর্যন্ত সরকারি ভাষা থাকবে তা নির্ধারণ করতে পারবে। তিনি এও বলেছিলেন যে, হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজি দেশের প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে থাকবে।
যদিও, ১৯৬৩ সালে সরকারি ভাষা আইন পাস হওয়ার পর ডিএমকে (দ্রাবিড় মুনেত্র কড়গম) তার তীব্র বিরোধিতা করে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অন্নাদুরাই, যাতে ত্রিচিতে একজন প্রতিবাদকারী চিন্নাস্বামী আত্মাহুতি দেন।
তামিলনাড়ুতে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের কারণ ছিল এই ভয় যে, কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে হিন্দির জ্ঞান বাধ্যতামূলক মানদণ্ড হয়ে উঠবে, যার ফলে তামিলভাষী ছাত্ররা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়তে পারে।
তামিলনাড়ুতে হয়েছিল সবচেয়ে বড় হিন্দি-বিরোধী প্রতিবাদ
১৯৬৫ সালে যখন হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার কথা উঠে, তখন তামিলনাড়ুতে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। ডিএমকে নেতা সি.এন. অন্নাদুরাই ঘোষণা করেন যে, ২৫ জানুয়ারী, ১৯৬৫ 'শোক দিবস' হিসেবে পালন করা হবে।
এই সময় অনেক জায়গায় হিংসাত্মক প্রতিবাদ হয়, যাতে ট্রেনের ডিব্বি এবং হিন্দিতে লেখা সাইনবোর্ডগুলিকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। মধুরাইতে প্রতিবাদকারী এবং কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
এই দাঙ্গায় প্রায় ৭০ জনের মৃত্যু হয়। এর পর প্রধানমন্ত্রী লाल बहादुर शास्त्री আশ্বাস দেন যে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ এবং সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ইংরেজির ব্যবহার চালু থাকবে।
১৯৬৭: হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের ফলে কংগ্রেস সরকার থেকে বেরিয়ে যায়
তামিলনাড়ুতে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের ফলে কংগ্রেসকে রাজনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ডিএমকে এবং ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত তীব্র আন্দোলনের ফলে ১৯৬৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজয়ের সম্মুখীন হয়।
এই নির্বাচনে ডিএমকে ক্ষমতায় আসে এবং কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী কে. কামরাজকে ডিএমকে-র একজন ছাত্র নেতা পরাজিত করেন। এর পর থেকে কংগ্রেস তামিলনাড়ুতে আর কখনো ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেনি।
সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ফলে বিতর্ক বৃদ্ধি
২০২২ সালে একটি সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করে যে, হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে আইআইটি-র মতো প্রযুক্তিগত এবং অ-প্রযুক্তিগত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিন্দি মাধ্যমকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
এছাড়াও, এই কমিটি সুপারিশ করে যে, হিন্দিকে জাতিসংঘের সরকারি ভাষার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তামিলনাড়ু সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী এম.কে. স্ট্যালিন এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছেন এবং এটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের 'হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র' বলে অভিহিত করেছেন।
নতুন শিক্ষানীতি থেকেও বিতর্ক
নতুন শিক্ষানীতি (NEP)ও তামিলনাড়ুতে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের একটি প্রধান কারণ। এই নীতি অনুযায়ী প্রতিটি স্কুলে তিনটি ভাষা পড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তবে, এতে হিন্দিকে বাধ্যতামূলক করা হয়নি, বরং এটি রাজ্য এবং ছাত্রদের পছন্দের উপর নির্ভর করবে।
কিন্তু এম.কে. স্ট্যালিনের দাবি, কেন্দ্রীয় সরকার এই নীতির মাধ্যমে তামিলনাড়ুতে সংস্কৃত বা হিন্দি চাপিয়ে দিতে চায়। বর্তমানে তামিলনাড়ুর স্কুলগুলিতে কেবলমাত্র তামিল এবং ইংরেজি পড়ানো হয়। তৃতীয় ভাষা হিসেবে সংস্কৃত, কন্নড়, তেলুগু বা হিন্দির মধ্যে যেকোনো একটি যোগ করা যাবে।