শেখচিল্লির গল্প: বোকা থেকে বুদ্ধিমানের পথে

শেখচিল্লির গল্প: বোকা থেকে বুদ্ধিমানের পথে
সর্বশেষ আপডেট: 27-12-2024

শেখচিল্লির মা তাকে ঘরে বেকার বসে থাকতে দেখে খুব চিন্তিত ছিলেন। একদিন তিনি ভাবলেন, কেন না শেখকে ব্যবসার জন্য পাঠানো যাক, যাতে কিছু আয় হয় এবং সে বেকারও না থাকে। এই উদ্দেশ্যে তার মা নিজের জমানো পুঁজি নিয়ে বাজার থেকে মখমলের কাপড়ের একটি থান কিনে আনলেন। কাপড়ের থান কেনার পর তার মা শেখকে বললেন, তিনি যেন এটি শহরের বড় বাজারে বিক্রি করে দেন। শেখচিল্লির মা তাকে বিশেষভাবে বললেন, বাজারে এই থানের দাম যেন এর আসল দামের থেকে ২ পয়সা বেশি বলা হয়। মায়ের কথা মনে গেঁথে শেখ কাপড়ের থান নিয়ে শহরের বাজারের দিকে রওনা হলো।

শহরের বড় বাজারে পৌঁছে সে এক জায়গায় কাপড়ের থানটি রাখল এবং ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর একজন লোক শেখের কাছে এসে থানের দাম জিজ্ঞাসা করল। বোকা শেখচিল্লির মায়ের কথা মনে পড়ল, তাই সে লোকটিকে বলল, “দাম আর কি, জনাব, আপনি শুধু থানের আসল দামের চেয়ে ২ পয়সা বেশি দেবেন।” শেখচিল্লির কথা শুনে লোকটি বুঝল যে সে বোকা, তাই সে তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে ৪ পয়সা বের করে মখমলের কাপড়ের থানের ওপর রাখল। শেখও খুশি মনে সেই পয়সা তুলে কাপড়টি লোকটির কাছে বিক্রি করে বাড়ির দিকে রওনা হলো।

বাড়ি ফেরার পথে শেখচিল্লি দেখল, একজন লোক বড় বড় তরমুজ বিক্রি করছে। সে আগে কখনও তরমুজ দেখেনি, তাই সে অবাক হয়ে ফল বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল, ‘এটা কী?’ শেখচিল্লির প্রশ্ন শুনে ফল বিক্রেতার বুঝতে দেরি হল না যে সে নির্ঘাত একটা মহা বোকা। ফল বিক্রেতা ভাবল কেন না তাকে বোকা বানানো যাক, তাই সে শেখকে বলতে লাগল, এটা কোনো সাধারণ জিনিস নয়, বরং হাতির ডিম। ফল বিক্রেতার কথা শুনে শেখচিল্লি খুব প্রভাবিত হল এবং ২ পয়সা দিয়ে সেই তরমুজটি কিনে নিল, যদিও সেই সময় একটি তরমুজের দাম ছিল ১ পয়সা।

শেখচিল্লি ভাবতে লাগল যে, এটি থেকে হাতির বাচ্চা বের হবে এবং বড় হলে সে হাতি বিক্রি করে অনেক টাকা রোজগার করবে। এই ভেবে খুশি হয়ে সে বাড়ির দিকে রওনা হলো। তরমুজ হাতে নিয়ে সে অর্ধেক পথ গিয়েছিল, হঠাৎ তার পেট খারাপ হয়ে গেল। আশেপাশে খালি ও নির্জন জায়গা দেখে সে একটি পাথরের উপর তরমুজটি রেখে ঝোপের পাশে পেট হালকা করতে গেল। হঠাৎ ঝোপের ভেতর থেকে সে দেখল একটি কাঠবিড়ালি তরমুজের পাশ থেকে লাফিয়ে বের হল এবং তরমুজটি পাথর থেকে নিচে পড়ে ফেটে গেল। শেখচিল্লির মনে হল, সেই কাঠবিড়ালিটি আর কেউ নয়, বরং তরমুজ থেকে বেরোনো হাতির বাচ্চা। 

এই ভেবে সে কাঠবিড়ালিটিকে ধরার জন্য তার দিকে দৌড়াল, কিন্তু ততক্ষণে কাঠবিড়ালিটি দ্রুত পালিয়ে গেল। হাতির বাচ্চা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় শেখচিল্লি হাত কচলাতে লাগল এবং দুঃখিত মনে বাড়ির দিকে রওনা হল। রাস্তায় শেখচিল্লির খুব খিদে পাওয়ায় সে একটি মিষ্টির দোকানে থামল এবং খাওয়ার জন্য সিঙ্গারা কিনল। যেই সে সিঙ্গারার একটি টুকরো মুখে দিল, একটি কুকুর তার সামনে এসে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। তার মনে হল কুকুরটি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত, তাই সে বাকি সিঙ্গারাটি কুকুরের সামনে ফেলে দিল। কুকুরটি চোখের পলকে পুরো সিঙ্গারাটি খেয়ে নিল এবং শেখচিল্লি ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাড়ির দিকে রওনা হলো।

বাড়িতে পৌঁছে সে দেখল তার মা বাড়িতে নেই। সে তার স্ত্রীকে পুরো ঘটনা খুলে বলল যে কীভাবে তার হাত থেকে হাতির বাচ্চাটি পালিয়ে গেল। তার কথা শুনে শেখচিল্লির স্ত্রী খুব রেগে গেল এবং তার সাথে ঝগড়া করতে লাগল। শেখের স্ত্রী বলতে লাগল যে, যদি সে তার অসাবধানতার জন্য হাতির বাচ্চাটিকে না হারাত, তাহলে সে একদিন তার উপর চড়ে ঘুরত। শেখচিল্লি ও তার স্ত্রী যখন ঝগড়া করছিল, তখন শেখচিল্লির মা বাড়ি ফিরে এলো। তাদের ঝগড়া করতে দেখে তিনি ঝগড়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। শেখ তার মাকে পুরো ঘটনা খুলে বলল যে, কীভাবে সে মখমলের কাপড়ের থানটি বিক্রি করেছে এবং তারপর রাস্তায় হাতির ডিম কিনেছে। শেখের কথা শুনে তার মা খুব রেগে গেলেন এবং তাকে তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে শেখচিল্লি রেগে হাঁটতে হাঁটতে সেই মিষ্টির দোকানের কাছে পৌঁছাল, যেখান থেকে সে সিঙ্গারা কিনেছিল। সে দেখল কুকুরটা এখনও সেখানেই বসে আছে। কুকুরটিকে দেখে তার রাগ সপ্তম আকাশে চড়ে গেল এবং সে তাকে মারতে তাড়া করল। কুকুরটি মিষ্টির দোকানের সামনে থেকে একটি গলির দিকে দৌড়াতে লাগল এবং শেখও তাকে মারার জন্য তার পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে কুকুরটি একটি বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল, যার দরজা খোলা ছিল। শেখচিল্লিও তার পিছনে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল। কুকুরটি দেওয়াল টপকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল এবং শেখচিল্লি তাকে খুঁজতে খুঁজতে একটি ঘরে গিয়ে পৌঁছাল। সেটি ছিল বাড়ির মালকিনের ঘর, যিনি সেই সময় সেখানে ছিলেন না। সে ঘরে সোনা-রূপার গয়নায় ভরা একটি ছোট সিন্দুক দেখতে পেল, যা খোলা ছিল। আশেপাশে কাউকে না দেখে সে একটি কাপড়ে সব গয়না ভরে একটি গাঁটরি বাঁধল এবং কেউ আসার আগেই সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।

সেই বাড়ি থেকে গয়না নিয়ে শেখচিল্লি সরাসরি তার বাড়ি পৌঁছাল এবং তার মায়ের হাতে গাঁটরিটা দিয়ে পুরো ঘটনা জানাল। শেখচিল্লির মা গয়না দেখে খুব খুশি হলেন এবং তারপর তিনি সেই গাঁটরিটি তাদের উঠোনে একটি গর্ত খুঁড়ে পুঁতে দিলেন। শেখচিল্লির মা তার বোকামির কথা ভালো করেই জানতেন। তিনি ভাবলেন, সে যে কাউকে এই কথা বলে দিতে পারে এবং তারা চুরির অভিযোগে ধরা পড়তে পারে। তাই শেখের মা একটি পরিকল্পনা করলেন এবং বাড়ির একজন চাকরকে বাজারে পাঠিয়ে এক বস্তা ধান ও মিষ্টি আনালেন। রাতে যখন শেখচিল্লি ঘুমিয়ে পড়ল, তখন তার মা সারা উঠোনে ধান ও মিষ্টি ছড়িয়ে দিলেন। গভীর রাতে শেখকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তার মা বললেন, দেখো, বাড়িতে ধান ও মিষ্টির বৃষ্টি হয়েছে। বাইরে এসে দেখে শেখচিল্লি তার মায়ের কথায় বিশ্বাস করল এবং ধানের মধ্যে থেকে মিষ্টি খুঁজে খেতে লাগল।

অন্যদিকে, যে ব্যক্তির স্ত্রীর গয়না শেখচিল্লি চুরি করেছিল, সে কোতোয়ালের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিল। ঘটনার তদন্ত করতে করতে কোতোয়াল ও সেই ব্যক্তি শেখচিল্লির বাড়িতে পৌঁছলেন। কোতোয়াল শেখচিল্লিকে চুরির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে সে চুরির কথা স্বীকার করল। শেখচিল্লি কোতোয়ালকে বলল যে, কীভাবে সে কুকুরের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির ভিতরে ঢুকেছিল এবং সেখান থেকে চুরি করা গয়না তার মা উঠোনে পুঁতে দিয়েছে। আরও বলল, গয়না পুঁতে দেওয়ার পর রাতে ধান ও মিষ্টির বৃষ্টি হয়েছে। শেখচিল্লির কথা শুনে কোতোয়াল ও সেই ব্যক্তির মনে হল সে বোকা, তাই এমন কথা বলছে। শেখচিল্লিকে পাগল ভেবে কোতোয়াল সেখান থেকে কোনও তদন্ত না করেই চলে গেল। এইভাবে শেখচিল্লির মা তার বুদ্ধিমত্তার দ্বারা সবাইকে বিপদের হাত থেকে বাঁচালেন। এরপর শেখচিল্লির মা অনেক দিন ধরে এক-একটি করে সেই গয়না বিক্রি করে সংসারের খরচ চালাতেন।

এই গল্প থেকে আমরা দুটি শিক্ষা পাই, প্রথমত, আমাদের কখনও কারও কথায় আসা উচিত নয়। দ্বিতীয়ত, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নেওয়া সিদ্ধান্ত দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।

Leave a comment