রায়গড় দুর্গ: মারাঠা গৌরবের এক অমূল্য নিদর্শন

রায়গড় দুর্গ: মারাঠা গৌরবের এক অমূল্য নিদর্শন
সর্বশেষ আপডেট: 16-05-2025

ভারতের পশ্চিম প্রান্তে, সহ্যাদ্ৰি পর্বতমালায় অবস্থিত রায়গড় দুর্গ কেবলমাত্র একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য নয়, বরং মারাঠা সাম্রাজ্যের গৌরব, পরাক্রম ও বীরত্বের প্রতীক। মহারাষ্ট্রের উত্তর কঙ্কণ অঞ্চলে অবস্থিত এই দুর্গ একসময় ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের রাজধানী ছিল। আজও এই স্থান হাজার হাজার পর্যটক ও ইতিহাসপ্রেমীদের আকর্ষণ করে।

রায়গড় দুর্গের ইতিহাস: এক বীরত্বের গাথা

রায়গড় দুর্গের ইতিহাস বীরত্ব ও স্বাধীনতার এক অমূল্য গাথা। প্রথমে চন্দ্ররাও মোরে নামক এক জমিদার এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন, এবং তখন একে ‘রায়রি’ বলা হত। কিন্তু ১৬৫৬ সালে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ চন্দ্ররাও মোরেকে পরাজিত করে এই দুর্গ দখল করেন। তিনি এর নাম পরিবর্তন করে ‘রায়গড়’ রাখেন এবং এটিকে মারাঠা সাম্রাজ্যের রাজধানী করে তোলেন। শিবাজী মহারাজ এই দুর্গকে আরও শক্তিশালী ও জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলেন যাতে এটি মারাঠা শক্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

১৬৭৪ সালে রায়গড় দুর্গে শিবাজী মহারাজের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হয়, যা ভারতীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই রাজ্যাভিষেক মোগলদের অনুমতি ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছিল, যা মারাঠা স্বাধীনতার প্রতীক। এই দুর্গ থেকেই শিবাজী ‘ছত্রপতি’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং তার সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। রায়গড় দুর্গ কেবলমাত্র একটি দুর্গ ছিল না, বরং মারাঠা সাহস ও আত্মসম্মানের প্রতীক ছিল। আজও এই দুর্গ মহারাষ্ট্রের গৌরব ও আত্মগৌরবের প্রতিনিধিত্ব করে।

দুর্গে হওয়া আক্রমণ ও ক্ষমতার পরিবর্তন

শিবাজী মহারাজের মৃত্যুর পর, ১৬৮৯ সালে মোগল সেনাপতি জুলফিকার খান রায়গড় দুর্গে আক্রমণ করে মারাঠা সেনাকে পরাজিত করে দুর্গ দখল করেন। সেসময়ের মারাঠা ছত্রপতি রাজারাম ভোঁসলের সেনাও পরাজিত হয়। এরপর মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব এই দুর্গের নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামগড়’ রাখেন। কিন্তু মারাঠারা হাল ছাড়েনি এবং কিছুদিন পর আবার এই দুর্গ দখল করে নেয়। মারাঠারা ১৮১৩ সাল পর্যন্ত রায়গড় দুর্গে শাসন করে এবং এটিকে তাদের শক্তির কেন্দ্রবিন্দু করে তোলে।

১৮১৮ সালে ইংরেজরা কামানের সাহায্যে এই দুর্গে ব্যাপক আক্রমণ করে এবং অবশেষে রায়গড় জয় করে। ইংরেজরা দুর্গ লুট করে এবং তাকে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করে। দুর্গের শক্তিশালী ও সুদৃঢ় নির্মাণ দেখে ইংরেজরা এর তুলনা ভূমধ্যসাগরের বিখ্যাত জিব্রাল্টারের সাথে করে এবং একে ‘পূর্বের জিব্রাল্টার’ বলে অভিহিত করে। রায়গড় দুর্গের এই ইতিহাস ভারতীয় ইতিহাসে বীরত্ব, সংগ্রাম ও ক্ষমতার পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত।

স্থাপত্য: জাঁকজমক ও কৌশলগত দক্ষতার মেলবন্ধন

রায়গড় দুর্গ কেবলমাত্র ইতিহাসেই নয়, তার স্থাপত্যেও একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে। যখন ছত্রপতি শিবাজী এই দুর্গ দখল করেন, তখন তিনি এটিকে শক্তিশালী ও সুন্দর করে তোলার জন্য বিখ্যাত স্থপতি হিরোজী ইন্দুলকরের সাহায্য নেন। এই দুর্গে অনেক এমন ভবন ও স্থাপনা আছে যা সেসময়ের জাঁকজমক ও কৌশলগত দক্ষতা উভয়কেই প্রতিফলিত করে।

শাহী প্রাসাদ ও রানীদের বাসস্থান (রানীবাশ): দুর্গের ভেতরে রাজা ও রানীদের বসবাসের জন্য শাহী প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল। রানীদের জন্য আলাদা যে কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল, তাকে রানীবাশ বলা হত। এই কক্ষগুলি আজও পুরোনো যুগের কাহিনী বলে, যদিও এগুলির অবস্থা এখন কিছুটা খারাপ হয়েছে। এই স্থানগুলি সেসময়ের শাহী জীবনযাত্রার পরিচয় দেয়।

শাহী টঙ্কশালা ও বাজার: দুর্গের ভেতরে প্রায় এক মাইল লম্বা বাজার ছিল যেখানে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য বিক্রি করত। এই বাজারে শাহী মুদ্রার টঙ্কশালাও ছিল, যেখানে মুদ্রা তৈরি করা হত। এই বাজার সেসময়ের অর্থনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এবং ব্যবসার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

মহাদ্বার: দুর্গের প্রধান প্রবেশদ্বার মহাদ্বার অত্যন্ত উঁচু ও জাঁকজমকপূর্ণ। এর উচ্চতা প্রায় ২০ মিটার। এই দ্বারের বিশালতা ও সুদৃঢ়তা দেখে সকলেই মুগ্ধ হন। এই দ্বার দুর্গের সুরক্ষা ও গৌরবের প্রতীক ছিল।

পালকী দ্বার: রানীদের জন্য একটি আলাদা ও নিরাপদ প্রবেশদ্বারও তৈরি করা হয়েছিল, যাকে পালকী দ্বার বলা হয়। এই দ্বার দিয়ে রানীরা স্বচ্ছন্দে ও নিরাপদে দুর্গে আসা-যাওয়া করতেন। এটি দেখায় যে সেসময় নারীদের সুরক্ষা ও সম্মানের বিশেষ ধ্যান রাখা হত।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থান

রায়গড় দুর্গের ভেতরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের অনেক স্থান রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জগদীশ্বর মন্দির, যাকে শিব মন্দিরও বলা হয়। এই মন্দিরে একটি বিশাল শিবলিঙ্গ স্থাপিত আছে, যার পূজা ভক্তরা আজও শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে করে। এই মন্দির কেবলমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং দুর্গের ইতিহাস ও সংস্কৃতিরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এছাড়াও, দুর্গের কাছে গঙ্গা সাগর নামক একটি বৃহৎ কৃত্রিম জলাশয় রয়েছে। এই জলাশয় কেবলমাত্র দুর্গের জন্য জলের প্রধান উৎস ছিল না, বরং দুর্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকেও বাড়িয়ে তুলেছিল। গঙ্গা সাগরে দুর্গের জাঁকজমকের প্রতিফলন স্পষ্ট দেখা যায়, যার ফলে এই স্থান আরও আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে। এই ধর্মীয় ও প্রাকৃতিক স্থানগুলি রায়গড় দুর্গের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে জীবন্ত রাখে।

শিবাজীর সমাধি ও টকমক টোক

১৬৮০ সালে যখন শিবাজী মহারাজের মৃত্যু হয়, তখন তাঁর সমাধি রায়গড় দুর্গেই তৈরি করা হয়। এই স্থান তাঁর সম্মান ও বীরত্বকে স্মরণ করার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সমাধির কাছে তাঁর একটি সুন্দর বসে থাকা মূর্তিও স্থাপিত আছে, যা শিবাজী মহারাজের বীরগাথা ও তাঁর আদর্শকে প্রতিফলিত করে। এখানে আগত মানুষ তাঁর বীরত্ব ও মহত্ত্ব অনুভব করতে পারেন।

রায়গড় দুর্গের আরেকটি ভয়ঙ্কর কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল টকমক টোক। এটি সেই স্থান যেখানে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হত। এখান থেকে কয়েদিদের গভীর খাদে ফেলে দেওয়া হত, যার ফলে তাদের মৃত্যু হত। টকমক টোকের দৃশ্য আজও মানুষের রুক্ষতা উদ্দীপিত করে এবং এটি দুর্গের কঠোর শাস্তি ও কঠোর নিয়মের স্মরণ করিয়ে দেয়।

বীরত্বের দৃষ্টান্ত: হীরাকণি বুর্জ

রায়গড় দুর্গের দেওয়ালের সাথে যুক্ত একটি অত্যন্ত বিখ্যাত লোককথা রয়েছে, যা বীরত্ব ও মাতৃত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। গ্রামের এক সাধারণ নারী, হীরাকণি, প্রতিদিন দুধ বিক্রি করার জন্য দুর্গে আসতেন। একবার সূর্যাস্তের পর দুর্গের দ্বার বন্ধ হয়ে যায়, এবং তিনি দুর্গের ভেতরেই আটকে পড়েন। তার দুধপুত কন্যার চিন্তায়, তিনি সাহস করে উঁচু পাহাড়ি পথ ধরে নেমে যান যাতে তিনি তার কন্যার কাছে পৌঁছাতে পারেন।

হীরাকণির এই বীরত্ব ও মাতৃত্ব প্রেমে মুগ্ধ হয়ে শিবাজী মহারাজ সেই বিশেষ স্থানে ‘হীরাকণি বুর্জ’ নির্মাণ করেন। এই বুর্জ সেই নারীর অদম্য সাহস ও সমর্পণের স্মরণ করিয়ে দেয়। আজও এই বুর্জ সেই গল্পের দৃষ্টান্ত হিসেবে দুর্গের শোভা বৃদ্ধি করে এবং আগত মানুষকে সাহসের বার্তা দেয়।

भवानी टोक ও রায়গড় संग्रहालয়

রায়গড় দুর্গের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ভবানী টোক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও রহস্যময় স্থান। বলা হয় যে মারাঠা রাজা রাজারাম ভোঁসলে মোগল সেনার ব্যাপক আক্রমণের সময় এই গোপন পথ ব্যবহার করে বড় মুশকিলে তার প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। এই পথ এতটাই লুকিয়ে ছিল এবং নিরাপদ ছিল যে শত্রু সেনা এটিকে খুঁজেও পায়নি। তাই ভবানী টোককে মারাঠা বীরত্ব ও কৌশলের প্রতীক বলে মনে করা হয়।

রায়গড় দুর্গ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রায়গড় संग्रहालয়ও ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য বিশেষ স্থান। এখানে মারাঠা সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত অসংখ্য পুরানো অস্ত্র, ছবি, দলিল এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক বস্তু রাখা হয়েছে। এই संग्रहालয় সেই যুগের কাহিনী বর্ণনা করে এবং মারাঠা সাম্রাজ্যের মহত্ত্বকে জীবন্ত রাখে। যারা ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে আগ্রহী, তাদের জন্য এই संग्रहालয় একটি অমূল্য ধন।

কেন রায়গড় একটি ভ্রমণের উপযুক্ত স্থান?

রায়গড় ঘুরে দেখার অনেক চমৎকার কারণ রয়েছে। প্রথমত, এখানে আপনি ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের জীবন ও তাঁর শাসন সম্পর্কে ঘনিষ্ঠভাবে জানতে পারবেন। এটি সেই দুর্গ যেখানে শিবাজী মহারাজ তাঁর শক্তি ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন এবং মারাঠা সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এই স্থান অত্যন্ত বিশেষ।

এছাড়াও, রায়গড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পাহাড়ি পথ ট্র্যাকিং প্রেমীদের একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা প্রদান করে। দুর্গের জাঁকজমকপূর্ণ স্থাপত্য ও চারিদিকে সবুজ প্রকৃতি আপনাকে একটি অনন্য অনুভূতি দান করবে। যদি আপনার পুরানো দুর্গ ও ইতিহাসে আগ্রহ থাকে, তাহলে রায়গড় আপনার জন্য একটি পারফেক্ট গন্তব্য, যেখানে আপনি ইতিহাস ও প্রকৃতি উভয়েরই আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন।

রায়গড় দুর্গ কেবলমাত্র একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্য নয়, বরং মারাঠা বীরত্ব, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের একটি জীবন্ত উদাহরণ। এখানকার গল্প, জাঁকজমকপূর্ণ স্থাপনা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রত্যেক আগতকে মুগ্ধ করে। ইতিহাস ও সাহসের প্রেমীদের জন্য রায়গড় একটি অবিস্মরণীয় ভ্রমণ স্থান।

Leave a comment