প্রতি বছর ২৭শে এপ্রিল জাতীয় গল্প বলার দিবস (National Tell A Story Day) পালিত হয়। এই দিনটি আমাদের জীবনে নানাভাবে রঙ যোগ করে এমন সকল অমূল্য গল্পের উৎসর্গ। গল্পগুলি শুধু আমাদের मनोरঞ্জন করে না, বরং আমাদেরকে একত্রিত করে, শেখায় এবং অনুপ্রাণিত করে।
এই বিশেষ দিনের উদ্দেশ্য হলো — গল্প বলার, শোনার এবং ভাগ করে নেওয়ার। ছোটবেলায় দাদি-নানির কাছ থেকে শোনা গল্প হোক, কোন বন্ধুর মজাদার ঘটনা হোক অথবা আমাদের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা — প্রতিটি গল্পেই কিছু না কিছু বিশেষ থাকে।
তাই আসুন, এই জাতীয় গল্প বলার দিবসে আমরা সকলে মিলে গল্পের এই জাদুকরী জগতে পা রাখি এবং স্মরণীয় মুহূর্ত গড়ে তুলি।
গল্পগুলি কেন এত বিশেষ?
গল্পগুলি শুধু সময় কাটানোর উপায় নয়, বরং এগুলি আমাদের অন্তরকে জোড়া লাগানোর মাধ্যম। যখন আমরা কোন গল্প শুনি অথবা বলি, তখন আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি এবং শিক্ষা অন্যদের সাথে ভাগ করে নিই। গল্পের মাধ্যমে আমরা আমাদের অন্তরের কথাও সহজেই বলে উঠতে পারি।
গল্পের জাদু শুধুমাত্র বাচ্চাদের জন্য নয়। বড়রাও গল্পে তেমনি প্রভাবিত হয়। গল্প আমাদের নতুন চিন্তাভাবনা দেয়, ভালো চরিত্র গঠন করে এবং আমাদের কল্পনার জগৎকে আরও বড় করে তোলে। একটি ছোট্ট গল্পও আমাদের জীবনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
গল্প বলার বড় বড় সুবিধা
- সৃজনশীলতা (Creativity) বৃদ্ধি পায়: যখন আমরা নতুন কোন গল্প শুনি অথবা বলি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক ভাবতে থাকে পরে কী হবে। আমরা কল্পনা করি চরিত্রগুলি কেমন দেখতে হবে, কী বলবে। এর ফলে আমাদের চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায়। পড়াশোনা হোক বা অফিসের কাজ, নতুন চিন্তাভাবনা সর্বত্র কাজে লাগে। গল্প বলার অভ্যাস আমাদের নতুন নতুন ধারণা ভাবতে সাহায্য করে।
- সম্পর্ক দৃঢ় হয়: যখন আমরা পরিবার বা বন্ধুদের সাথে বসে গল্প ভাগ করে নিই, তখন আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। একটি ভালো গল্প হাসি, আনন্দ এবং কখনও কখনও অনুভূতি দিয়েও জড়িত থাকে। এর ফলে অন্তরের সম্পর্ক আরও গভীর হয়। আজকাল যখন সবাই মোবাইলে ব্যস্ত, তখন গল্প বলার একটি সুন্দর উপায় হতে পারে আপনজনদের সাথে যুক্ত থাকার।
- বলার এবং বোঝানোর উপায় উন্নত হয়: গল্প বলার মাধ্যমে আমরা আমাদের কথা সুন্দর করে বোঝাতে শিখি। কোন শব্দ কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে সবার মনোযোগ ধরে রাখতে হবে — এগুলি সব গল্প বলতে বলতে আসে। এর ফলে আমাদের যোগাযোগ কৌশল (communication skills)ও উন্নত হয়, যা পড়াশোনা, চাকরি বা ব্যবসা সর্বত্র কাজে লাগে।
- শিখতে সহজ হয়: গল্পের মাধ্যমে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সহজেই শিখি। যেমন কোন গল্প আমাদের সততা, পরিশ্রম অথবা সাহায্য করার শিক্ষা দিতে পারে। বাচ্চা হোক বা বড়, গল্পের মাধ্যমে প্রাপ্ত শিক্ষা বেশি দিন মনে থাকে। তাই স্কুল এবং ঘরে গল্প বলার অভ্যাস অত্যন্ত উপকারী।
জাতীয় গল্প বলার দিবস কীভাবে পালন করবেন?
এই দিনটি খুব সহজ এবং আকর্ষণীয়ভাবে পালন করা যায়। আপনাকে শুধুমাত্র অন্তর থেকে একটি গল্প বেছে নিতে হবে এবং তা কারো সাথে ভাগ করে নিতে হবে। আসুন কিছু চমৎকার উপায় জেনে নেই:
- আপনার সবচেয়ে পছন্দের গল্পটি বলুন: আপনার কাছে অবশ্যই এমন কোন গল্প থাকবে যা আপনার অন্তরের খুব কাছাকাছি — ছোটবেলার কোন ঘটনা, দাদীর কোন অনুপ্রেরণামূলক গল্প অথবা স্কুলের দিনের কোন মজাদার ঘটনা। আজকের দিনটিতে তা আপনার পরিবার বা বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নিন।
- বই থেকে গল্প পড়ুন: যদি আপনি নিজে থেকে গল্প তৈরি করতে না চান তাহলে কোন ভাল বই নিন। তার মধ্য থেকে কোন আকর্ষণীয় গল্প পড়ুন এবং সবাইকে শোনান। বাচ্চাদের জন্য ছবিসহ বই (Picture books) খুব ভালো বিকল্প হতে পারে।
- সোশ্যাল মিডিয়ায় গল্প ভাগ করে নিন: আজকের ডিজিটাল যুগে আপনি আপনার গল্প ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব অথবা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেও ভাগ করে নিতে পারেন। আপনার কণ্ঠে একটি ছোট্ট গল্প রেকর্ড করুন এবং আপনার নেটওয়ার্কের সাথে শেয়ার করুন। এর ফলে আপনার সৃজনশীলতাও প্রকাশিত হবে এবং আপনার গল্প আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে।
পারিবারিক গল্পের সময় তৈরি করুন
পরিবারের সাথে একটি গল্পের সময় নির্ধারণ করুন। রাতে খাওয়ার পরে অথবা ঘুমোনোর আগে ১৫-২০ মিনিট সময় বের করে প্রতিদিন একজন সদস্য একটি গল্প বলুক। এর ফলে শুধুমাত্র বাচ্চারাই আনন্দ পাবে না, বরং পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও বৃদ্ধি পাবে।
- নিজের গল্প লিখুন: যদি আপনার কাছে এমন কোন বিশেষ অভিজ্ঞতা থাকে যা অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে পারে, তাহলে তা শব্দে ঢেলে দিন। আপনি আপনার গল্প একটি ডায়েরিতে লিখতে পারেন অথবা ব্লগ অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সকলের সাথে ভাগ করে নিতে পারেন।
- বাচ্চাদের জন্য গল্পের গুরুত্ব: আজকের সময়ে বাচ্চারা বেশিরভাগ সময় মোবাইল, টিভি এবং ভিডিও গেমসে ব্যস্ত থাকে। পড়াশোনার বাইরে তাদের বেশিরভাগ সময় স্ক্রিনে চলে যায়। এমন পরিবেশে যদি আমরা তাদের প্রতিদিন কিছু ভালো গল্প শোনাই, তাহলে এর খুব ভালো প্রভাব পড়তে পারে।
- গল্প বাচ্চাদের মনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়: যখন বাচ্চারা গল্প শুনে, তখন তাদের কল্পনাশক্তি (imagination) বৃদ্ধি পায়। তারা ভাবে গল্পের চরিত্রগুলি কেমন দেখতে হবে, কী করছে। এর ফলে বাচ্চাদের মস্তিষ্ক তীক্ষ্ণ হয়।
- শিখতে আগ্রহও বৃদ্ধি পায়: গল্পের মাধ্যমে বাচ্চারা নতুন জিনিস জানার জন্য উৎসাহী হয়। তারা প্রশ্ন করে, ভাবে এবং শিখতে আনন্দ পায়। এভাবে তাদের পড়াশোনায়ও আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।
- চরিত্র গঠন এবং নৈতিক মূল্যবোধও আসে: অনেক গল্পে ভালোবাসা, সত্যতা, পরিশ্রম এবং সাহায্য করার মত বিষয় শেখানো হয়। যখন বাচ্চারা এই গল্পগুলি শুনে, তখন এই মূল্যবোধগুলি তাদের আচরণেও ধীরে ধীরে আসে।
- ধ্যান ও একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়: যখন বাচ্চা গোটা গল্প মনোযোগ সহকারে শুনে, তখন তার একাগ্রতা (concentration) বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সে স্কুল এবং অন্যান্য কাজেও বেশি মনোযোগ দিতে পারে।
প্রত্যেকের কাছেই একটি গল্প থাকে
ছোট হোক বা বড়, সাধারণ হোক বা অনুপ্রেরণামূলক — প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটি গল্প থাকে। আপনার জীবনের কোন অভিজ্ঞতা অন্যের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে। তাই কখনোই আপনার গল্পকে ছোট ভাববেন না।
জাতীয় গল্প বলার দিবস আমাদের এটাই মনে করিয়ে দেয় যে গল্পে একটি জাদু থাকে — এমন জাদু যা অন্তরকে জুড়ে দেয়, স্বপ্নকে উড়িয়ে দেয় এবং জীবনকে উজ্জ্বল করে তোলে।
আজকের এই বিশেষ দিনে একটি প্রতিজ্ঞা করুন — যে আপনি বছরে অন্তত কয়েকবার আপনার প্রিয়জনদের সাথে গল্প ভাগ করে নেবেন। কারণ গল্পগুলি শুধুমাত্র আমাদেরকে একত্রিত করে না, বরং আগামী প্রজন্মের জন্যও আমাদের স্মৃতিগুলিকে জীবন্ত রাখে।