পরমাণু বিজ্ঞানের অগ্রদূত ডঃ এম. আর. শ্রীনিবাসনের অবসান

পরমাণু বিজ্ঞানের অগ্রদূত ডঃ এম. আর. শ্রীনিবাসনের অবসান
সর্বশেষ আপডেট: 20-05-2025

ভারতের পরমাণু শক্তি কর্মসূচির ভিত্তি সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ডঃ মালুর রামাস্বামী শ্রীনিবাসনের আজ, ২০ মে ২০২৫, তামিলনাড়ুর উটিতে ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছে। স্বাধীন ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপনকারী অল্প কিছু বিজ্ঞানীর একজন ছিলেন তিনি।

নয়াদিল্লি: ভারতের পরমাণু কর্মসূচিকে দিক নির্দেশনা প্রদানকারী জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ডঃ এম. আর. শ্রীনিবাসনের মঙ্গলবার (২০ মে ২০২৫) ৯৫ বছর বয়সে উটিতে মৃত্যু হয়েছে। দেশের পরমাণু শক্তি ক্ষেত্রে তিনি একজন প্রধান স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাকে ভারতের পরমাণু কর্মসূচির জনক হিসেবে খ্যাত মহান বিজ্ঞানী ডঃ হোমি জহাঙ্গীর ভাবার সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল।

ডঃ শ্রীনিবাসন ডঃ ভাবার সাথে মিলে ভারতের প্রথম পরমাণু গবেষণা রিঅ্যাক্টর 'অপ্সরা' নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা আগস্ট ১৯৫৬ সালে সফলভাবে সম্পন্ন হয়। তার অবদান ভারতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ইতিহাসে সর্বদা স্মরণীয় থাকবে।

বিজ্ঞান জীবনের সূচনা

ডঃ শ্রীনিবাসনের জন্ম হয় ৫ জানুয়ারী ১৯৩০ সালে কর্ণাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরুতে। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন মৈসুরের ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে, যেখানে তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজিকে প্রধান ভাষা বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। বিজ্ঞানে তার আগ্রহ বাল্যকাল থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও পদার্থবিজ্ঞান ছিল তার প্রিয় বিষয়, তবুও তিনি ইঞ্জিনিয়ারিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেন এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৫২ সালে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন এবং এরপর কানাডার খ্যাতনামা ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। গ্যাস টারবাইন প্রযুক্তিতে তার দক্ষতা ছিল, যা পরবর্তীতে ভারতের শক্তি খাতে বিপ্লব সাধন করে।

হোমি ভাবার সাথে প্রাথমিক কাজ

ডঃ শ্রীনিবাসন ১৯৫৫ সালে ভারতীয় পরমাণু শক্তি বিভাগ (DAE) এ যোগদান করেন। এই সময় তিনি পরমাণু শক্তির জনক ডঃ হোমি জহাঙ্গীর ভাবার সাথে কাজ করার সুযোগ পান। তিনি ভাবার দলে যোগ দেন এবং ভারতের প্রথম পরমাণু গবেষণা রিঅ্যাক্টর 'অপ্সরা' নির্মাণে সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা পালন করেন। এই রিঅ্যাক্টর ১৯৫৬ সালে সম্পূর্ণ হয় এবং ভারতের বৈজ্ঞানিক আত্মনির্ভরতার দিকে প্রথম পদক্ষেপ স্থাপন করে।

ডঃ হোমি ভাবা ভারতের দীর্ঘমেয়াদী পরমাণু কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, ১৯৬৬ সালে ভাবার একটি বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। কিন্তু তার পরিকল্পনাগুলিকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব ডঃ শ্রীনিবাসন ও তার দল গ্রহণ করে। বিক্রম সারাভাই মহাকাশ কর্মসূচির নেতৃত্ব গ্রহণের পর, ডঃ শ্রীনিবাসন ও ডঃ হোমি সেঠনা মিলে পরমাণু শক্তি কর্মসূচিকে অবিরাম গতি প্রদান করে।

এনপিসিআইএলের প্রতিষ্ঠা ও নেতৃত্ব

১৯৮৭ সালে ডঃ শ্রীনিবাসন পরমাণু শক্তি কমিশন (AEC)-এর চেয়ারম্যান এবং পরমাণু শক্তি বিভাগের সচিব নিযুক্ত হন। সে বছরই তিনি ভারতীয় পরমাণু শক্তি নিগম লিমিটেড (NPCIL) প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর প্রথম চেয়ারম্যান হন। তার নেতৃত্বে দেশে ১৮টি পরমাণু শক্তি ইউনিট নির্মিত হয়, যা ভারতের শক্তি নিরাপত্তাকে সুদৃঢ় করে।

ডঃ শ্রীনিবাসন কেবল একজন প্রযুক্তিবিদ বিজ্ঞানীই ছিলেন না, বরং একজন দক্ষ প্রশাসনিক নেতাও ছিলেন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি ভারত সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। এই সময় তিনি বিজ্ঞান, শক্তি এবং প্রযুক্তি বিভাগগুলিকে পরামর্শ প্রদান করেন। এছাড়াও তিনি দুইবার (২০০২-২০০৪ এবং ২০০৬-২০০৮) জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। এই ভূমিকায় তিনি দেশের শক্তি নীতি এবং বৈজ্ঞানিক নিরাপত্তার রূপরেখা তৈরিতে অবদান রাখেন।

ভারত রত্ন সমতুল্য পুরষ্কার

ভারত সরকার তার অবদানকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করে ক্রমান্বয়ে পদ্মশ্রী (১৯৮৪), পদ্মভূষণ (১৯৯০) এবং পদ্মবিভূষণ (২০১৫) পুরস্কারে ভূষিত করে। এই পুরষ্কারগুলি কেবল সম্মানই নয়, বরং সেই বৈজ্ঞানিক সংকল্পের স্বীকৃতি, যা ভারতকে একটি শক্তিশালী পরমাণু রাষ্ট্র করে তুলেছে। ডঃ শ্রীনিবাসনের জীবন সেই যুবসমাজের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস, যারা বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিংকে কেবল পেশা নয়, বরং রাষ্ট্রসেবার মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে। তার অবদান এই প্রমাণ করে যে প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতা কেবলমাত্র গবেষণাগারে নয়, দূরদর্শিতা, নেতৃত্ব এবং সেবাবোধ থেকে আসে।

Leave a comment