ভারতীয় সঙ্গীত জগতে যদি কোনো একটি নামকে শ্রদ্ধা এবং সম্মানের সর্বোচ্চ শিখরে রাখা হয়, তবে সেই নামটি হলো মাদুরাই শানমুখাভাদিবু সুব্বুলক্ষ্মী—যাকে আমরা সবাই স্নেহ ও সম্মানের সঙ্গে এম.এস. সুব্বুলক্ষ্মী নামে জানি। তাঁর গান, তাঁর সুর, তাঁর ভক্তি, এবং তাঁর জীবন, সবকিছুই ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অমূল্য রত্ন হয়ে উঠেছে।
ছোটবেলা থেকেই সুরের সাধনা
এম.এস. সুব্বুলক্ষ্মীর জন্ম ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯১৬ সালে, তামিলনাড়ুর মাদুরাই শহরে, এক সঙ্গীতপ্রেমী পরিবারে। তাঁর মা শানমুখাভাদিবু স্বয়ং একজন বিখ্যাত বীণা বাদিকা ছিলেন, যাঁর কাছ থেকে সুব্বুলক্ষ্মী প্রাথমিক সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন। সঙ্গীত তাঁর জীবনে শ্বাসের মতো মিশে ছিল। তিনি মাত্র ১০ বছর বয়সে প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশ করেন, যা তাঁর সুরের যাত্রার সূচনা ছিল।
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি দুটি ধারার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন—কর্ণাটক সঙ্গীতের গভীরতায় ডুব দেন শেম্মাঙ্গুড়ি শ্রীনিবাস আয়ারের কাছে, অন্যদিকে, হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের মাধুর্য শেখেন পণ্ডিত নারায়ণরাও ব্যাসের কাছে। এই দ্বৈত সাধনা তাঁকে একটি অনন্য স্থান দেয়।
সঙ্গীতের মঞ্চ থেকে বিশ্বমঞ্চ পর্যন্ত
১৯৩৩ সালে, যখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর, তখন তিনি চেন্নাইয়ের বিখ্যাত মিউজিক একাডেমিতে প্রথমবার অনুষ্ঠান করেন। তাঁর কণ্ঠস্বর এবং ভক্তি সঙ্গীতের পরিবেশনা সেখানে উপস্থিত সকল শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে। এরপর তিনি ভারতের প্রায় সকল প্রধান ভাষায় ভক্তিগীতি গেয়েছেন এবং বহু স্মরণীয় অ্যালবাম রেকর্ড করেছেন।
১৯৬৬ সালে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সঙ্গীত পরিবেশন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তিনি এই কীর্তি স্থাপনকারী প্রথম ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। এটি কেবল একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান ছিল না, বরং ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতিধ্বনি সারা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার এক ঐতিহাসিক সুযোগ ছিল।
অভিনয়েও সুরের সাধনা
সুব্বুলক্ষ্মী অভিনয় জগতেও তাঁর সুরের ছাপ রেখে গিয়েছেন। যদিও তিনি কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, তবে তাঁর মন সবসময় ভক্তি সঙ্গীত এবং আত্মিক পরিবেশনায় নিবদ্ধ ছিল। ১৯৪৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘মীরা’-তে তিনি সন্ত মীরার ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং তাঁর সুরেলা কণ্ঠে এমন সব ভজন গেয়েছেন যা আজও ভক্তদের হৃদয়ে গেঁথে আছে। 'পায়ো জি ম্যায়নে রাম রতন ধন পায়ো' এবং 'হরি তুম হারো জন কী ভীড়' -এর মতো ভজনগুলি তিনি যে আবেগ এবং ভক্তি দিয়ে গেয়েছেন, তা আজও শ্রোতাদের আত্মাকে স্পর্শ করে যায়।
মহাপুরুষদের শ্রদ্ধার কারণ
মহাত্মা গান্ধী-র মতো মহান ব্যক্তিও সুব্বুলক্ষ্মীর ভক্তিপূর্ণ গান শুনে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘যদি সুব্বুলক্ষ্মী শুধু ‘হরি তুম হারো’ গেয়ে দেন, তবে সেটি আমার কাছে যেকোনো সঙ্গীতের চেয়েও মধুর হবে।’ এই উক্তিটি কেবল তাঁর কণ্ঠের সৌন্দর্যকেই তুলে ধরে না, বরং তাঁর গানের আত্মিক শক্তি এবং ভক্তিপূর্ণ ভাবাবেগের গভীরতার প্রমাণ, যা সরাসরি মন ও আত্মাকে স্পর্শ করত।
সম্মান এবং স্বীকৃতি
এম.এস. সুব্বুলক্ষ্মী ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত প্রথম সঙ্গীতজ্ঞ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। তিনি তাঁর সঙ্গীত এবং সারল্যের মাধ্যমে ভারতের মানুষের হৃদয়ে যে স্থান তৈরি করেছেন, তা আজও অটুট রয়েছে। তাঁর প্রধান পুরস্কার ও সম্মানগুলির মধ্যে রয়েছে:
- ১৯৫৪: পদ্মভূষণ
- ১৯৫৬: সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার
- ১৯৬৮: সঙ্গীত কলা নিধি (এই সম্মান প্রাপ্ত প্রথম মহিলা)
- ১৯৭৪: র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার (এই সম্মান প্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী)
- ১৯৭৫: পদ্মবিভূষণ
- ১৯৮৮: কালিদাস সম্মান
- ১৯৯০: ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরস্কার
- ১৯৯৮: ভারতরত্ন
জীবনের অন্তিম সময় এবং চিরন্তন উত্তরাধিকার
১১ই ডিসেম্বর, ২০০৪ সালে, ৮৮ বছর বয়সে চেন্নাইয়ে এম.এস. সুব্বুলক্ষ্মীর প্রয়াণ হয়, কিন্তু তাঁর চলে যাওয়ার পরেও তাঁর মধুর এবং ভক্তিপূর্ণ কণ্ঠস্বর মানুষের হৃদয়ে জীবিত আছে। তাঁর গাওয়া ভজন আজও মন্দির, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং ঘরগুলিতে শ্রদ্ধার সঙ্গে শোনা হয়। তাঁর গান কেবল সঙ্গীত ছিল না, বরং আত্মাকে ছুঁয়ে যাওয়া এক সাধনা ছিল, যা সকল বয়সের এবং প্রজন্মের মানুষকে আধ্যাত্মিক শক্তি ও অনুপ্রেরণা দেয়।