করবা চৌথ: ভারতীয় নারীর শ্রদ্ধা, প্রেম ও সমর্পণের উৎসব

করবা চৌথ: ভারতীয় নারীর শ্রদ্ধা, প্রেম ও সমর্পণের উৎসব
সর্বশেষ আপডেট: 13-06-2025

ভারতীয় সংস্কৃতিতে নারীর অবস্থান অত্যন্ত সম্মানজনক। এখানে উৎসব-পার্বণ শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার, সংবেদনশীলতাকে প্রকাশ করার এবং সামাজিক মূল্যবোধকে সুদৃঢ় করার মাধ্যমও। এমনই একটি পবিত্র ও আবেগঘন উৎসবের নাম — করবা চৌথ।

করবা চৌথ ভারতীয় বিবাহিত নারীদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এই উৎসবটি বিশেষ করে উত্তর ভারতে পালিত হয়, যেখানে স্ত্রীরা স্বামীর দীর্ঘায়ু, সুখ-সমৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য কামনা করে নিরজলা ব্রত পালন করে। এটি নারীর নিষ্ঠা, প্রেম ও তপস্যার প্রতীক।

করবা চৌথের অর্থ ও নামের উৎপত্তি

‘করবা’ একটি ধরণের মাটির পাত্র যা পূজায় ব্যবহৃত হয়, এবং ‘চৌথ’ অর্থ ‘চতুর্থী’, অর্থাৎ চাঁদের চতুর্থ দিন। এই উৎসবে করবা (মাটির পাত্র) এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, যাতে জল ভরে চাঁদকে অর্ঘ্য দেওয়া হয়।

করবা চৌথ কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থী তিথিতে পালিত হয়, যা সাধারণত অক্টোবর বা নভেম্বরে আসে।

করবা চৌথের পৌরাণিক কাহিনী

করবা চৌথ সংক্রান্ত অনেক পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত কাহিনী হল বীরবতীর।

বীরবতী ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী এবং তার ভাইদের সাথে অত্যন্ত ভালোবাসা রাখতেন। তিনি স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা করে প্রথমবার করবা চৌথের ব্রত পালন করেন। ব্রতের কঠোর নিয়ম ও সারাদিন অনাহারে-নির্জলে থাকার ফলে তার অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। তার বোনের অবস্থা দেখে তার ভাইরা চিন্তিত হয় এবং তারা ছলনার মাধ্যমে একটি কৃত্রিম চাঁদ তৈরি করে তাকে দেখায়, যার ফলে বীরবতী ব্রত ভেঙে ফেলে। কিন্তু ব্রত শেষ করার সাথে সাথেই তিনি তার স্বামীর মৃত্যুর খবর পান। এটি শুনে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হন এবং তিনি পূর্ণ শ্রদ্ধাভরে দেবীর আরাধনা করে প্রায়শ্চিত্ত করেন। তার সত্যিকারের ভক্তি ও তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে যমরাজ তার স্বামীকে পুনরায় জীবন দান করেন।

এই কাহিনী প্রেম, আস্থা ও সংকল্পের অনুকরণীয় উদাহরণ হয়ে উঠে এবং তখন থেকেই এই উৎসবটি প্রতিবছর নারীরা ব্যাপক উৎসাহের সাথে পালন করতে থাকে।

করবা চৌথের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক

করবা চৌথের উল্লেখ ইতিহাসেও পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতে যখন রাজা-মহারাজা যুদ্ধে যেতেন, তখন তাদের স্ত্রীরা তাদের স্বামীর সুরক্ষা ও বিজয়ের জন্য ব্রত পালন করতেন। এই ব্রতটি শুধু ব্যক্তিগত প্রেম নয়, বরং জাতি ও সমাজের রক্ষার কামনারও প্রতীক ছিল।

এই উৎসবটি নারীদের আধ্যাত্মিক শক্তি, মানসিক দৃঢ়তা ও সামাজিক সম্মান প্রদান করে। সামূহিকভাবে নারীদের সাজানো-গুছানো, একসাথে গান গাওয়া এবং একে অপরের মঙ্গল কামনা করা এটিকে একটি সামাজিক উৎসবের রূপ দেয়।

ব্রতের পদ্ধতি ও পূজা প্রক্রিয়া

করবা চৌথ ব্রতের প্রক্রিয়া অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ ও শ্রদ্ধাভরে পালিত হয়। এর শুরু হয়

  1. সরগী দিয়ে (সকালের থালি)

সরগী হল সেই খাবার যা শাশুড়ি সূর্যোদয়ের আগে বউকে দেন। এতে মিষ্টান্ন, শুকনো ফল, ফল, মথরি, হালুয়া ইত্যাদি থাকে। এটি প্রেম ও আশীর্বাদের প্রতীক।

  1. সারাদিনের নিরজলা ব্রত

এই দিন নারীরা সূর্যোদয় থেকে চন্দ্রোদয় পর্যন্ত অন্ন ও জল ছাড়া ব্রত পালন করে। এটি সংযম, শক্তি ও শ্রদ্ধার পরীক্ষার দিন।

  1. শৃঙ্খল ও পূজা

সন্ধ্যায় নারীরা সুন্দর পোশাক পরে, বিশেষ করে লাল বা গোলাপী রঙের শাড়ি বা লেহেঙ্গা। হাতে মেহেদী, মাথায় বিন্দি, চুড়ি, বিছুয়া এবং মঙ্গলসূত্র দিয়ে পুরো শৃঙ্খল করা হয়।

  1. করবা পূজা

সন্ধ্যার সময় নারীরা একত্রিত হয়ে করবা চৌথের কথা শোনে এবং করবা (মাটির পাত্র) এর পূজা করে। পূজার থালিতে দীপ, ফল, মিষ্টান্ন, চাল, রোলী ইত্যাদি থাকে।

  1. চাঁদকে অর্ঘ্য ও ব্রত পূর্ণ

চন্দ্রোদয়ের সময় নারীরা চালনির মধ্য দিয়ে চাঁদ দেখে অর্ঘ্য দেয় এবং তারপর স্বামীকে দেখে ব্রত ভাঙ্গে। স্বামী, স্ত্রীকে জল পান করিয়ে এবং মিষ্টান্ন খাইয়ে ব্রত পূর্ণ করে।

করবা চৌথ ও আধুনিক যুগ

আজকের আধুনিক যুগে, যেখানে জীবনের গতি তীব্র এবং সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে করবা চৌথের মতো উৎসব প্রেম ও ঘনিষ্ঠতার একটি সুন্দর মাধ্যম হিসেবে উঠে এসেছে।

এখন অনেক স্বামীও তাদের স্ত্রীর জন্য ব্রত পালন করে, যা এই উৎসবটিকে সমতা ও পারস্পরিক সম্মানের প্রতীক করে তোলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় করবা চৌথ উদযাপনের ছবি, জুটির ঐক্য ও প্রেমকে তুলে ধরে।

লোকগীত, মেহেদী ও ঐতিহ্য

করবা চৌথে নারীদের জন্য গীত ও কাহিনীর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ঐতিহ্যগত লোকগীতগুলিতে স্বামীর দীর্ঘায়ু ও প্রেমের অনুভূতি প্রতিফলিত হয়। নারীরা মিলে ‘করবা চৌথের কথা’, ‘চাঁদা মা’মা’, ‘কুমারী কন্যাদের ব্রত’ ইত্যাদি গান গায়।

মেহেদীকে এই দিনে শুভ বলে মনে করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, যত গাঢ় মেহেদী রচনা করা হয়, স্বামীর প্রেম ততই প্রবল হয়।

সামাজিক গুরুত্ব

করবা চৌথ শুধুমাত্র একটি ব্রত নয়, বরং এটি সামাজিক সম্প্রীতি ও নারী সবলীকরণের প্রতীক। যখন নারীরা মিলে ব্রত পালন করে, পূজা করে, তখন পারস্পরিক সহযোগিতা ও আবেগগত যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়।

এই উৎসবটি নারীদের আত্মশক্তি, ধৈর্য্য ও আস্থা অনুভব করায়। আজকের সময়ে যখন সম্পর্কে দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, করবা চৌথের ব্রত আবারও সম্পর্ককে জোড়া দেওয়ার একটি কড়ি হয়ে উঠছে।

বিবাহপূর্ব ও অবিবাহিতা কন্যাদের জন্যও

কিছু স্থানে অবিবাহিতা কন্যারাও मनचाहा বর পাওয়ার কামনায় এই ব্রত পালন করে। তারাও পূর্ণ আস্থার সাথে সরগী খেয়ে, নিরজলা ব্রত পালন করে এবং ভগবান চন্দ্রমাকে আদর্শ স্বামীর প্রার্থনা করে।

বিভিন্ন প্রান্তে করবা চৌথ

যদিও করবা চৌথ প্রধানত উত্তর ভারত—পঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, রাজস্থান এবং উত্তর প্রদেশ—এ পালিত হয়, তবে এখন এই উৎসবটি সমগ্র ভারতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

পঞ্জাবে এটিকে উৎসবের মতো পালন করা হয়—ভাঙ্গড়া, গিদা, রঙিন অনুষ্ঠান এবং উপহারের আদান-প্রদান হয়। রাজস্থানে করবার উপর ‘বিন্দি’ লাগিয়ে কথা বলা হয় এবং করবাকে ১৩ বার ফেরনে ঘোরানো হয়।

করবা চৌথের সাথে জড়িত বিশ্বাস

চাঁদের দর্শন: মনে করা হয় যে চাঁদ স্বামীর জীবনে শান্তি, সৌভাগ্য ও আয়ুর কারক।

চালনির মধ্য দিয়ে দেখা: প্রথমে চালনির মধ্য দিয়ে চাঁদ এবং তারপর স্বামীকে দেখার প্রথা, এটি প্রতীক যে স্বামী জীবনের ‘চাঁদ’ এবং তার রক্ষার জন্য নারী কোনও তপস্যার পিছনে পড়ে না।

সরগীর গুরুত্ব: এটি শুধু খাবার নয়, শাশুড়ির প্রেম ও আশীর্বাদের প্রতীক।

করবা চৌথ একটি উৎসব যা ভারতীয় নারীর শ্রদ্ধা, প্রেম ও সমর্পণের উৎসব। এটি একটি এমন ব্রত, যেখানে শুধু চাঁদই নয়, প্রতিটি নারীর নিষ্ঠা, সৌন্দর্য ও আস্থাও একটি চাঁদের মতো পবিত্রতা নিয়ে আসে।

আজ যখন সম্পর্কে স্থায়িত্বের চ্যালেঞ্জ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন করবা চৌথ আমাদের শেখায় যে, ত্যাগ, প্রেম ও আস্থা প্রতিটি সম্পর্কের ভিত্তি। এই উৎসবটি একটি নারীর আভ্যন্তরীণ শক্তি, মানসিক ভারসাম্য ও প্রেমের গভীরতার প্রমাণ।

তাই আসুন, এই করবা চৌথে আমরা সকলে আমাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করি, প্রেম ও সম্মানের প্রদীপ জ্বালি, এবং নারীর এই অতুলনীয় সমর্পণকে প্রণাম করি।

Leave a comment