হিন্দু পঞ্জিকায় বারো মাসের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, যেখানে প্রতিটি মাসই কোনো না কোনো আধ্যাত্মিক, ধর্মীয় অথবা প্রাকৃতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসগুলির মধ্যে একটি হল জ্যৈষ্ঠ মাস, যাকে বছরের সবচেয়ে গরম মাস বলা হয়। ২০২৫ সালে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরু হয়েছে ১৩ মে এবং এর সমাপ্তি হবে ১১ জুন। এই সমগ্র সময়কালটিকে অত্যধিক তাপ এবং প্রচণ্ড গরমের জন্য পরিচিত।
কিন্তু জ্যৈষ্ঠ মাসের সবচেয়ে বিশেষ দিক হল এতে জলদান, ঘড়াদান এবং শীতল ফল বিতরণ অত্যন্ত পুণ্যকরি মনে করা হয়। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ এবং ঐতিহ্যেও এই মাসে জল পান করানোকে ‘মহাপুণ্য কर्म’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। আসুন জেনে নেই, জ্যৈষ্ঠ মাসে জল পান করানো কেন বিশেষ, এর ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক কারণ কি এবং সমাজের জন্য এর গুরুত্ব কি।
জলদানকে কেন বলা হয় ‘মহাদান’?
হিন্দু ধর্মে দানকে একটি শ্রেষ্ঠ কर्म বলে মনে করা হয়, এবং জলদানকে তার মধ্যেও ‘মহাদান’ বলা হয়। এর পেছনে ধর্মীয় বিশ্বাস রয়েছে যে এই সময় যখন প্রতিটি প্রাণী জলের এক ফোঁটা পানির জন্যও তৃষ্ণার্ত, সেই সময় কোনও তৃষ্ণার্তকে জল পান করানো শুধুমাত্র শরীরকে স্বস্তি দেয় না, আত্মাকেও সন্তুষ্টি প্রদান করে। শাস্ত্র অনুযায়ী, যখন কোনও ব্যক্তি তৃষ্ণায় কাতর হয় এবং আপনি তাকে জল পান করান, তখন সে হৃদয় থেকে আশীর্বাদ করে। এই আশীর্বাদ ঈশ্বরের আশীর্বাদের সমান ফলপ্রসূ হয়। বিশেষ করে সূর্যদেব এই কাজে প্রসন্ন হন এবং তাঁর ভক্তদের উপর কৃপা বর্ষণ করেন।
সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও উপকারী
শুধু ধর্মীয় নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও জ্যৈষ্ঠ মাসে জলদানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই সময় প্রচণ্ড গরমের ফলে শরীরে পানির অভাব হয়। ডিহাইড্রেশন এবং হিট স্ট্রোকের আশঙ্কা বেড়ে যায়। এই অবস্থায় যদি সার্বজনীন স্থানে পানীয়ের ব্যবস্থা করা হয় অথবা রাস্তাঘাটে চলাচলকারী মানুষদের ঠান্ডা জল পান করানো হয়, তাহলে এটি স্বাস্থ্যের দিক থেকেও সমাজে একটি বড় সেবা বলে মনে করা হয়।
ঘড়া, ফল ও ছায়ার দান
জ্যৈষ্ঠ মাসে ঘড়ার দানও অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী, মাটির ঘড়া শুধুমাত্র ঠান্ডা জল সংরক্ষণের মাধ্যম নয়, এটি পৃথিবী তত্ত্বের সাথে যুক্ত হওয়ার ফলে প্রাকৃতিক শক্তিকেও সামঞ্জস্যপূর্ণ করে। এছাড়াও আম, খরবুজ, তরমুজ, শিম, কাকড়ি ইত্যাদি ফলের দানও পুণ্যকর।
এই ফলগুলিতে জলের পরিমাণ বেশি থাকে, যার ফলে গরম থেকে স্বস্তি পাওয়া যায়। যদি এগুলি কোনও দরিদ্র ব্যক্তিকে দান করা হয়, তাহলে তা শুধু তার তৃষ্ণা নিবারণের কারণই নয়, দাতার জীবনে সমৃদ্ধি, সৌভাগ্য ও শান্তি আনে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তৃষ্ণার্তকে জল
পুরাণে একটি কাহিনী পাওয়া যায় যেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই এক বৃদ্ধার কাছ থেকে জল গ্রহণ করেন এবং তাকে মোক্ষের বরদান দেন। এতে বুঝতে পারা যায় যে জলদান শুধু দান নয়, ঈশ্বরের সেবার সমতুল্য।
কিভাবে জলদান করবেন?
- বাড়ির বাইরে মাটি বা তামার ঘড়ায় ঠান্ডা জল ভরুন।
- রাস্তার ধারে, মন্দিরে অথবা সার্বজনীন স্থানে পানীয়ের ব্যবস্থা করুন।
- তৃষ্ণার্ত মানুষদের নিজেই জল পান করান, শুধু জল রেখে দেওয়া যথেষ্ট নয়।
- জলের সাথে তুলসীপাতা বা গোলাপের পাপড়ি দিন, যাতে এর স্বাদ ও শক্তি উভয়ই বৃদ্ধি পায়।
জ্যৈষ্ঠ মাস শুধু তাপের সময় নয়, সেবা ও পুণ্যার্জনের সুযোগও। জল পান করানো, ঘড়া দেওয়া ও শীতল ফল দান করা—এই সকল কাজ শুধু অন্যদের স্বস্তি দেয় না, ব্যক্তির জীবনেও ইতিবাচক শক্তি এবং সুখ-সমৃদ্ধি আনে। তাই ২০২৫ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে আপনিও কোনও তৃষ্ণার্তকে জল পান করিয়ে ‘মহাদান’ এর পুণ্য লাভ অবশ্যই করুন। এটাই সত্য ধর্মের পালন এবং মানবতার সেবা।